বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্প | Bangladesh Garments Industry

বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্প | Bangladesh Garments Industry

লিখেছেনHabibur Rahman
Smart Factory 4.0 Consultant for Textile Apparel Industries.
Published on June 25, 2022

বাংলাদেশের গার্মেন্টস কারখানা গুলো কেন একের পর এক বন্ধ হয়ে যাচ্ছে

এই মুহূর্তে আমাদের কি করণীয়ঃ গত ২৭শে আগস্ট প্রথম আলো পত্রিকায় “উৎপাদনে না থাকা কারখানার সদস্যপদ বাতিল করবে বিজিএমইএ” শীষর্ক খবরটা যখন পড়ি সেদিন থেকেই মনটা ভীষণ উৎকণ্ঠিত হয়ে আছে।

বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্প:

দীর্ঘদিন ধরে উৎপাদনে না থাকা কারখানার সদস্যপদ বাদ দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেছে তৈরি পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ। এতে ১ হাজার ১০০-র বেশি সদস্যপদ বাতিল হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানিয়েছেন সংগঠনটির নেতারা। জানা যায়, চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে বিজিএমইএর বোর্ড সভায় কয়েক বছর ধরে উৎপাদন বন্ধ ও সদস্যপদ নবায়ন করছে না, এমন কারখানাকে সংগঠন থেকে বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন নেতারা। এরপরই ৩১ অক্টোবরের মধ্যে সদস্যপদ নবায়ন করতে নোটিশ দেওয়া হয়। যারা সদস্যপদ নবায়ন করবে না, তারা বাদ যাবে।

বিজিএমইএর বর্তমান সদস্যসংখ্যা প্রায় ৪ হাজার ৭০০। তবে সচল কারখানা প্রায় অর্ধেক। কারণ, নিয়মিতভাবে সরাসরি রপ্তানির জন্য কাঁচামালের আমদানি প্রাপ্যতা বা ইউপি নেয় ১৮০০-২০০০ পোশাক কারখানা। আবার গত এপ্রিলে বিজিএমইএর নেতৃত্ব নির্বাচনে ঢাকার ১ হাজার ৮৫৩ কারখানার মালিক ভোট দেন। আর চট্টগ্রামের ভোটার ছিলেন ৪৬১ জন। তার মানে সংগঠনটির সদস্যদের বড় অংশই ব্যবসায় নেই। Bangladesh Garments Industry

বিজিএমইএর নেতারা জানান, একসময় পোশাক রপ্তানিতে কোটা-সুবিধা ছিল। সেই সুবিধা নিতে অনেক কাগুজে কোম্পানিও হয়। সেগুলো বিজিএমইএর সদস্যপদও নিয়েছিল। কোটা-সুবিধা উঠে যাওয়ার পর সেসব কাগুজে কারখানা বিজিএমইএর নির্বাচনে প্রভাব খাটাতে ব্যবহার হয়ে আসছিল। একই উদ্দেশ্যে বন্ধ কারখানার সদস্যপদও বছরের পর বছর টিকিয়ে রাখা হয়। গত নির্বাচনে শতাধিক অস্তিত্বহীন কারখানার মালিক ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে ভোটার হয়েছেন।

২০০২ থেকে এখন পর্যন্ত বিজিএমইএর সদস্যপদ হারায় ঢাকা ও চট্টগ্রামের ১ হাজার ৬৫৪ প্রতিষ্ঠান। তার মধ্যে সর্বশেষ ২০১৪ সালে বিভিন্ন অভিযোগে ৪৪৫ কারখানার সদস্যপদ বাতিল করা হয়। সংগঠনের বার্ষিক চাঁদা পরিশোধ না করা, বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে ধার্য করা চাঁদা না দেওয়া ও বিভিন্ন সময়ে কমপ্লায়েন্সের শর্ত পালনে ব্যর্থ হওয়াসহ নানা কারণে কারখানাগুলো সদস্যপদ হারায়। জানতে চাইলে বিজিএমইএর সভাপতি ফারুক হাসান গত মঙ্গলবার প্রথম আলোকে বলেন, উৎপাদনে না থাকা কারখানাকে সদস্যপদ থেকে বাদ দেওয়ার প্রাথমিক প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। প্রথম ধাপে কমপক্ষে ১ হাজার ১৪০ কারখানা সদস্যপদ হারাতে পারে। আগামী বছরের জানুয়ারিতে নিষ্ক্রিয় সদস্যদের বাদ দিতে দ্বিতীয় ধাপের প্রক্রিয়া শুরু করা হবে। তিনি বলেন, শুদ্ধি অভিযান শেষ হলে সংগঠন নানাভাবে উপকৃত হবে।

এই খবরটা কি পরিমান ভয়াবহ আমাদের সর্ব বৃহৎ ইন্ডাস্ট্রির জন্য তা নিশ্চয়ই বুঝিয়ে বলতে হবেনা। সরকারী ব্যাংক গুলো থেকে যারা ব্যাংকিং সহায়তা নিয়ে ইন্ডাস্ট্রি করেছিলেন তাদের মাঝেই শত শত উদ্যোক্তা হারিয়ে গেছেন। কি পরিমান কারখানা এখন সিক ফ্যাক্টরীর তালিকা ভুক্ত হয়ে গেছে, তা নিয়ে স্বয়ং ব্যাংক সমুহই উৎকণ্ঠিত। কিন্তু এই জটিলতম বিষয়টা নিয়ে সংশ্লিষ্ট সকল মহলের কোন প্রকার উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা, পদক্ষেপ, করণীয় কোন কিছুই বিশেষ ভাবে নজরে পড়ছেনা।

আপনারা সকলেই কিন্তু জানেন যে বড় বড় অনেকগুলো নাম আমাদের ইন্ডাস্ট্রি থেকে মুছে গিয়েছে। এক সময় ৩০/৪০ হাজার মানুষ যে কারখানায় কাজ করতো , তাদের নাম কিন্তু হারিয়ে গেছে। কেন যেন আমি বিশ্বাস করতে পারিনা এই ইন্ডাস্ট্রিতে ৪০ লক্ষ মানুষ যে এখনো কাজ করছে ! এই ব্যাপারে সঠিক তথ্য দেয়ার মত কোন প্রতিষ্ঠান, পত্রিকা কিংবা কোন ধরণের তথ্য ভান্ডার আমাদের কিন্তু নেই।

আমি ব্যক্তিগত ভাবে ভাল মানের কারখানার নাম ৩০০ এর বেশি খুঁজে পাইনা। আমার নিজের মার্কেট এনালাইসিস অনুযায়ী এই কারখানা গুলো আবার তিন ভাগে ভাগ করেছি।

► প্রথম সারির ১০০ বড় কারখানা সমন্ধে যতটুকু জানি, গড়পড়তা ১৫০০০ থেকে ২০০০০ কর্মচারীর কর্মসংস্থান এখনো তাদের রয়েছে।

► দ্বিতীয় সারির ১০০ কারখানাতে ১০০০০ থেকে ১৫০০০ মানুষ কর্মরত।

► তৃতীয় সারির ১০০ কারখানাতে ৭০০০ থেকে ১০০০০ মানুষ কর্মরত।

এর পরের কাতারে যারা আছেন, তাদের সকলেই বিপদের মধ্যেই আছেন। কোন মতে এখনো কারখানা টিকিয়ে রেখেছেন। তাহলে ব্যাপারটা কোনদিকে যাচ্ছে, নিশ্চয় আমাদের বোঝার মত বিচক্ষণতা আছে।

এর মাঝে একটা সুসংবাদ হল, প্রথম সারির কারখানা গুলোর সকলেই গ্রীন ফ্যাক্টরীতে নতুন করে ইনভেস্ট করার ফলে, বিশ্ব বাজারে আমাদের দেশের একটা চমৎকার ইমেজ তৈরী হয়েছে। কিন্তু ঐ সকল উদ্যোক্তার একটা বড় অংশের আক্ষেপ হল, গ্রীন ফ্যাক্টরী করার ফলে আমাদের এক সেন্ট ও মূল্য বৃদ্ধি ঘটাতে পারিনি ! তাহলে আমাদের এই সাস্টেইনিবিলিটি ইনিশিয়েটিভ নেয়ার জন্য বিদেশী ব্র্যান্ড গুলোর এত প্রচার প্রচারণায় আমাদের ইন্ডাস্ট্রি কি পেল ?

বিশেষ একটা খবর সোশ্যাল মিডিয়াতে আপনারা প্রতিদিন দেখছেন যে, কোন একটা কারখানা, কিংবা একটা ইউনিট, কিংবা ওয়াশিং এতখানি জমি সহ বিক্রয় করা হবে। শুধু মাত্র আগ্রহী ক্রেতা গণ কে যোগাযোগ করতে বলা হয়।

এই ব্যাপারটা এই মুহূর্তে যে,কতখানি ভয়াবহ পরিণামের দিকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে, তা নিয়ে আমাদের বিজ্ঞ মহলের কোন প্রকার সংশয় কিন্তু আমার দৃষ্টিতে পড়েনাই , আপনাদের কারো নজরে এলে আমাকে একটু লিংকটা শেয়ার করবেন।

একটা সংবাদ দেখতে ভালোই লাগে যখন পুরাতন কোন উদ্যোক্তা নতুন কোন বিল্ডিংয়ের, নতুন কারখানার ছবি পোস্ট করেন। তার মানে নতুন কোন উদ্যোক্তা তৈরী হচ্ছেনা।

পুরো আলোচনা টাকে আমি কয়েকটা স্তরে বিভক্ত করে আমার যুক্তি সমূহ উত্থাপন করতে চাইছি।

আমরা বিভিন্নভাবে মূলত সমস্যাটায় আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ফেলেছি। আমার বিশ্লেষণ গুলো নিম্নরুপঃ

► জাতিগত জটিলতাঃ

► আন্তর্জাতিক বাজার সংক্রান্ত জটিলতাঃ

► নীতিমালা সংক্রান্ত জটিলতাঃ

► উদ্যোক্তা সম্পর্কিত জটিলতাঃ

► শ্রমিক সংক্রান্ত জটিলতাঃ

► কর্মচারী সংক্রান্ত জটিলতাঃ

► কর্মকর্তা সংক্রান্ত জটিলতাঃ

► ব্যাংকিং, অর্থায়ন এবং নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত জটিলতাঃ

► ইন্ডাস্ট্রির নেতৃত্ব সংক্রান্ত জটিলতাঃ

► পোশাক শিল্পের ধরণ, পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত জটিলতাঃ

► পোশাক শিল্পের বিগত ২০০ বছরের ইতিহাস পর্যালোচনাঃ

বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্প যাত্রা শুরু করে ষাটের দশকে। তবে সত্তরের দশকের শেষের দিকে রপ্তানিমুখী খাত হিসেবে এই শিল্পের উন্নয়ন ঘটতে থাকে। বর্তমানে এটি বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানিমুখী শিল্পখাত।

পোশাক শিল্প তৈরি পোশাক বা আরএমজি (Readymade Garments) নামে সমধিক পরিচিত। সুবিন্যস্ত কারখানায় বৃহদায়তনে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে পোশাক উৎপাদনের ঘটনা বাংলাদেশে অপেক্ষাকৃত নতুন। ষাটের দশকের শুরু পর্যন্ত ব্যক্তি উদ্যোগে ক্রেতাদের সরবরাহকৃত এবং তাদেরই নির্দেশিত নকশা অনুযায়ী স্থানীয় দর্জিরা পোশাক তৈরি করতো। শুধুমাত্র শিশুদের জামাকাপড় এবং পুরুষদের পরিধানযোগ্য গেঞ্জি ছাড়া প্রকৃতপক্ষে ষাটের দশক পর্যন্ত তৈরি পোশাক শিল্পের অভ্যন্তরীণ বাজার ছিল না বললেই চলে। সত্তরের দশকের শেষার্ধ থেকে মূলত একটি রপ্তানিমুখী খাত হিসেবে বাংলাদেশে তৈরি পোশাক শিল্পের উন্নয়ন ঘটতে থাকে। তৈরি পোশাক শিল্পের অভ্যন্তরীণ বাজারও দ্রুত সম্প্রসারিত হয় এবং এই খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সকলের আয় বৃদ্ধি পায় ও জীবনযাত্রায় পরিবর্তন আসে। খাতটি কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে দ্রুত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে এবং তা বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন ও জিডিপিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখে।

১৯৮০ সাল পর্যন্ত কাঁচা পাট ও পাটজাত দ্রব্য মোট রপ্তানিতে ৫০% অবদান রেখে রপ্তানি আয়ে শীর্ষস্থান দখল করেছিল। আশির দশকের শেষার্ধে পাট ও পাটজাত দ্রব্যের আয়কে অতিক্রম করে পোশাক শিল্প রফতানি আয়ে প্রথম স্থানে চলে আসে। ১৯৯৯ সালে এই শিল্পখাতে সরাসরি কর্মসংস্থান হয় ১.৪ মিলিয়নেরও বেশি লোকের, যার মধ্যে শতকরা প্রায় ৮০ জন মহিলা। তৈরি পোশাক শিল্পের সম্প্রসারণের সাথে সাথে বস্ত্র, সুতা, আনুষঙ্গিক উপকরণ, প্যাকেটজাতকরণের উপকরণ ইত্যাদি শিল্পেরও সম্প্রসারণ হতে থাকে। এতদ্ব্যতীত পরিবহন, ব্যাংকিং, শিপিং এবং ইন্সুরেন্স সেবার চাহিদাও বৃদ্ধি পেতে থাকে। এর সবটাই অতিরিক্ত কর্মসংস্থানের সৃষ্টি করে। এ ধরনের নতুন পরোক্ষ-কর্মসংস্থান মূলত তৈরি পোশাক শিল্প কর্তৃক সৃষ্টি যার সুবিধাভোগী মোট ২,০০,০০০ শ্রমজীবী।

বাংলাদেশ থেকে তৈরি পোশাকের (কেবলমাত্র ওভেন শার্ট) প্রথম চালানটি রপ্তানি হয় ১৯৭৮ সালে। এরপরেই বিদেশি ক্রেতাদের আগ্রহ বেড়ে যায় এবং এই শিল্প দ্রুত বেড়ে ওঠে। ১৯৮১-৮২ সালে মোট রপ্তানি আয়ে এই খাতের অবদান ছিল মাত্র ১.১%। ২০১০ সালের মার্চ মাসে তৈরি পোশাক শিল্পের অবদান দাঁড়িয়েছে মোট রপ্তানি আয়ের ৭৬%। সময়ের পরিক্রমায় তৈরি পোশাক আরও সম্প্রসারিত হয়ে ওভেন এবং নিটিং উপখাতে বিভক্ত হয়। ২০০২ সালে পোশাক রপ্তানিতে ওভেন ও নিটিং-এর অবদান ছিল যথাক্রমে ৫২.০৬% এবং ৮.৫৮%। পরবর্তীকালে নিট পোশাক উপখাত ওভেন উপখাতের তুলনায় দ্রুত বৃদ্ধি পায়। ২০০৮-০৯ অর্থ বছরে নিট উপখাত ওভেন উপখাতকে অতিক্রম করে সমগ্র রপ্তানিতে ৪১.৩৮% (৬৪২৯ মিলিয়ন ডলার) অবদান রাখে, বিপরীতে ওভেন পোশাক ৩৮.০২% (৫৯১৮.৫১ মিলিয়ন ডলার) নিয়ে দ্বিতীয় স্থানে নেমে আসে। ২০০৮-০৯ অর্থ বছরে নিট ও ওভেন একত্রে আমদানিকৃত কাঁচামালের মূল্যসহ সাড়ে ১২ বিলিয়ন ডলারে উপনীত হয় এবং সাড়ে ২২ লাখ মহিলা শ্রমিকের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে।

তৈরি পোশাক শিল্পের সম্প্রসারণ বাংলাদেশের সমাজে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন সাধন করেছে। পরোক্ষভাবে এই সব সেবাখাতে প্রায় আড়াই লাখের মতো মানুষের কর্মসংস্থান হয়। জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখা ছাড়াও তৈরি পোশাক শিল্প সাড়ে ২২ লাখ নারী শ্রমিকের জীবনযাত্রার লক্ষণীয় পরিবর্তন সাধন করেছে এবং তারা অর্থনীতিতে অবদান রাখছে। শ্রমজীবী নারীদের অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন পরিবারে তাদের অবস্থানের পরিবর্তন আনয়নে সক্ষম হয়েছে, আর্থিক সক্ষমতা অর্জনের কারণে এসব নারী শ্রমিকের সামাজিক মর্যাদাও বৃদ্ধি পেয়েছে। চাকরির সুবিধাদি ভোগকারী বাবা, ভাই এবং স্বামীর ঐতিহ্যগত পিতৃতান্ত্রিক কর্তৃত্বের ক্ষেত্রে পরিবর্তন সাধন করেছে। অধিকাংশ শ্রমজীবী নারী এখন বিয়ে এবং সন্তান ধারণের ক্ষেত্রে নিজেদের পছন্দ অনুযায়ী সিদ্ধান্তের কথা বলতে পারে। তারা পরিবারিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রেও অংশ গ্রহণ করতে পারছে। সমাজে বাল্যবিবাহের সংখ্যা কমেছে, সেই সাথে হ্রাস পেয়েছে জন্মহার। শ্রমজীবী মেয়েরা তাদের ছোট ছোট ভাইবোনদের যত্ন নিচ্ছে এবং স্কুলে পাঠাচ্ছে। ফলে দেশে সাক্ষরতার হার বৃদ্ধি পাচ্ছে। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, তৈরি পোশাক শিল্পখাতের সম্প্রসারণ নতুন উদ্যোক্তাদল সৃষ্টি করছে যারা উৎপাদনের ক্ষেত্রে শক্তিশালী বেসরকারি খাত গড়ে তুলেছে। এই উদ্যোক্তাদের একটি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নারী। বাংলাদেশের অন্যতম পুরনো রপ্তানিমুখী পোশাক কারখানা ‘বৈশাখী’ ১৯৭৭ সালে প্রতিষ্ঠা করেন একজন নারী। বর্তমানে তৈরি পোশাক কারখানায় অনেক নারী ঊর্ধ্বতন নির্বাহী পদে অধিষ্ঠিত।

এই শিল্প মূলত উপচুক্তি ভিত্তিক। অর্থাৎ বাংলাদেশি উদ্যোক্তা বিদেশি ক্রেতার উপচুক্তিকারক বা মূল চুক্তির অংশ বিশেষ সম্পাদন করে। এটা গড়ে উঠেছে বিদেশি ক্রেতাদের সি-এম (Cut and Made অর্থাৎ কাট এবং তৈরি কর) পদ্ধতিতে ফরমায়েশ অনুসারে। ক্রেতারাই চাহিদা অনুযায়ী সকল কাপড় এবং সহায়ক দ্রব্য সরবরাহ করে অথবা তাদেরই নির্দেশিত উৎস থেকে বাংলাদেশি উপচুক্তিকারকদের পোশাক তৈরির জন্য কাপড় আমদানি করতে হতো। বস্ত্র এবং সংশ্লিষ্ট উপকরণ পাওয়ার পর উপচুক্তিকারকরা বিদেশি ক্রেতাদের দেওয়া নকশা অনুযায়ী কাপড় কেটে ও সেলাই করে মোড়কে বেঁধে রপ্তানি করতো। বিদেশি ক্রেতাদের বাংলাদেশকে নির্বাচিত করার কারণ এখানে পোশাক তৈরিতে খরচ সবচাইতে কম।

শুরুতে এই শতভাগ রপ্তানিমুখী শিল্প সম্পূর্ণভাবেই আমদানিকৃত কাঁচামাল নির্ভর ছিল। এই নির্ভরশীলতার কারণে পরিস্থিতি ছিল খুবই নাজুক। কিন্তু সময়ের ব্যবধানে বাংলাদেশি মালিকেরা অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ হয় এবং পরিস্থিতির উন্নতি হয়। স্থানীয় উদ্যোক্তারা পশ্চাৎ-সংযোগ শিল্পের বিকাশ ঘটায় এবং স্থানীয়ভাবেই দক্ষতা বৃদ্ধি করে মানসম্পন্ন রপ্তানিযোগ্য সুতা ও কাপড় উৎপাদন শুরু করে। তাছাড়া পোশাক শিল্প রং ও প্রক্রিয়াজাত করার পর কাপড় কেটে এবং সেলাই করে রপ্তানিযোগ্য পণ্যে রূপান্তরিত করার যোগ্যতা অর্জন করেছে। গত ১৫ বছরে এই কার্যক্রম আরও বিস্তৃতি লাভ করেছে। দ্রুত পশ্চাৎ সংযোগ শিল্প গড়ে ওঠার কারণে এই শিল্প আর আগের মতো কাঁচামাল আমদানির উপর নির্ভরশীল নয়। ২০১০ সালের এপ্রিল মাসের পরিসংখ্যান অনুসারে ওভেন পোশাকের ৫০% আর নিট পোশাকের মাত্র ১০% আমদানি নির্ভর ছিল।

বর্তমানে বাংলাদেশে অনেক বড় মানের ভার্টিক্যাল সেট-আপ সম্বলিত কিংবা পূর্ণাঙ্গ পোশাক কারখানা গড়ে উঠেছে। পোশাক তৈরীর সাথে জড়িত সকল কিছুর বন্দোবস্তকেই আমরা ভার্টিক্যাল সেট-আপ কারখানা বলে থাকি। এ সমস্ত কারখানা তুলা থেকে সুতা, সুতা থেকে বুনন করে গ্রে কাপড় তৈরী করা, সেই গ্রে কাপড়টাকে রং করা, নানা প্রকার ট্রিটমেন্ট করা, প্রক্রিয়াজাত করা এবং ক্যালেন্ডারিংসহ অন্যান্য সকল কাজ সম্পন্ন করে থাকে । তাছাড়া এ সমস্ত রপ্তানিযোগ্য কাপড় ছাড়া ও স্থানীয় কারখানা গুলোতে দেশীয় চাহিদা মেটানোর কাজে ও শক্ত অবস্থান দখল করেছে। এই কারখানা সমূহে বিদেশি ক্রেতাদের নকশা পত্র, চাহিদা পত্র, বিভিন্ন দেশের জন্য বিভিন্ন সাইজের পোশাক, সকল প্রকার ফরমায়েশ অনুযায়ী সেলাই করে, আন্তর্জাতিক মানের প্যাকিং করে সারা বিশ্বের বিভিন্ন শহরে পাঠানো হয়। আমাদের ব্যাক ওয়ার্ড লিংকেজ প্রতিষ্ঠান কিংবা পশ্চাৎ সংযোগ শিল্প গড়ে ওঠার ফলে প্রতিযোগিতামূলক বাজারে বাংলাদেশের অবস্থান পূর্বের তুলনায় আর ও অনেক দৃঢ় সুসংহত হয়েছে।

বিগত বছরে তৈরি পোশাক শিল্প বিস্ময়কর প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে।

১৯৭৮ সালে মাত্র ৯টি রপ্তানিমুখী পোশাক তৈরির কারখানায় উৎপাদিত পণ্য রপ্তানি করে আনুমানিক এক মিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ অর্থ আয় করেছিল বাংলাদেশ। অনেক কারখানা ছিল ছোট আকারের এবং এখানে উৎপাদিত পণ্য রপ্তানির পাশাপাশি স্থানীয় বাজারেও বিক্রি হতো। এরকম চারটি ছোট পুরাতন কারখানার নাম রিয়াজ গার্মেন্টস, প্যারিস গার্মেন্টস, জুয়েল গার্মেন্টস এবং বৈশাখী গার্মেন্টস। এর মধ্যে রিয়াজ গার্মেন্টস ছিল পথ-প্রদর্শক, যা ঢাকায় রিয়াজ স্টোর নামে একটি ছোট দর্জির কারখানা হিসেবে ১৯৬০ সালে কাজ শুরু করে। এটি আনুমানিক ১৫ বছর স্থানীয় বাজারে কাপড় সরবরাহ করেছে। ১৯৭৩ সালে কারখানাটি নাম পরিবর্তন করে মেসার্স রিয়াজ গার্মেন্টস লিমিটেড নামে আত্মপ্রকাশ করে। পরবর্তীকালে কার্যক্রম সম্প্রসারিত করে ১৯৭৮ সালে প্যারিসভিত্তিক একটি ফার্মের সাথে ১৩ মিলিয়ন ফ্রাংক মূল্যের ১০ হাজার পিস ছেলেদের শার্ট রপ্তানি করে। রিয়াজ গার্মেন্টসই প্রথম বাংলাদেশ থেকে সরাসরি পোশাক রপ্তানি করে।

বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের জয়যাত্রায় রিয়াজ গার্মেন্টস এর অবদান, উত্থান, বিকাশ এবং সংকুচিত হওয়ার বিশ্লেষণ কেন জরুরী।

অ্যাপোলো-১১ এর সেই তিন নভোচারী নীল আর্মস্ট্রং, মাইকেল কলিন্স ও এডউইন অলড্রিন কিন্তু তাদের ওয়ার্ল্ড গুডউইল ট্যুরের অংশ হিসেবে বাংলাদেশেও এসেছিলেন। তারা নেমেছিলেন তেজগাঁও বিমানবন্দরে। সেদিন হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে এই তিন নভোচারীর জন্য আয়োজন করা হয়েছিল এক নাগরিক সংবর্ধনা অনুষ্ঠান। শত শত মানুষের উল্লাস ও চিৎকারের ভিড়ের মধ্যে সেদিন রিয়াজউদ্দিন নামের একজন গার্মেন্টস ব্যবসায়ীও ছিলেন, যিনি নিজের দোকান ‘রিয়াজ স্টোর’ এ বানানো তিনটি শার্ট নিয়ে গিয়েছিলেন তিন নভোচারীকে শুভেচ্ছা জানাতে।

সেদিন রিয়াজউদ্দিনের উপহার তারা গ্রহণ করেছিলেন এবং পরবর্তীতে তিনজনের কাছ থেকে ধন্যবাদ ও প্রশংসামিশ্রিত একটি চিঠিও পান রিয়াজউদ্দিন।

সেই বিশেষ দিনে বাকি সবাই যখন চাঁদে পা রাখা তিনজন নভোচারীকে প্রত্যক্ষ করার খুশি বুকে নিয়ে বাড়ি ফিরছিলো, তখন রিয়াজউদ্দিনের মনে ছিল অন্য চিন্তা। রিয়াজউদ্দিন স্বপ্ন দেখছিলেন নিজের ব্যবসাকে বৈদেশিক বাজারে ছড়িয়ে দেওয়ার। তিনি ভাবছিলেন যদি এই তিন আমেরিকান নভোচারী তার বানানো শার্টের প্রশংসা করতে পারেন তাহলে তা হয়তো অন্য পশ্চিমা নাগরিকদের কাছেও সমাদৃত হবে।  ১৯৭৮ সালের ২৮ জুলাই ফ্রান্সে ১০ হাজার রিয়াজ শার্ট রপ্তানি করার মধ্য দিয়ে রিয়াজউদ্দিনের স্বপ্ন পূরণের যাত্রা শুরু হয়। এভাবেই রিয়াজউদ্দিন স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক হয়ে ওঠেন।

রিয়াজউদ্দিন তার পারিবারিক গার্মেন্টস ব্যবসায়ে যোগ দেন ১৯৫৮ সালে। করাচি থেকে কাপড় ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক জিনিসপত্র এনে তারা বিক্রি করতেন। দুই বছর পরে তিনি ও তার ভাতিজা মাইজুদ্দিন মিলে চকবাজারে ‘রিয়াজ স্টোর’ চালু করেন। তারা দেশীয় বাজারে পুরুষের শার্ট, নারীদের লেগিংস, তৈরি পোশাকসহ অন্যান্য পণ্য বিক্রি শুরু করেন। তৎকালীন উর্দু রোডে তাদের ফ্যাক্টরিতে সারাদিন আটটি সেলাই মেশিন চলতো অর্ডার পাওয়া কাপড় বানানোর কাজে।

রিয়াজ স্টোরে বিশেষ কিছু উন্নতমানের শার্ট তৈরি হতো যা বানানোর জন্য তিনি মারওয়াড়ি বণিকদের কাছ থেকে এক ধরণের জাপানি কাপড় সংগ্রহ করতেন। কয়েক বছরের মধ্যেই সারা দেশে রিয়াজ স্টোরের সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। চট্টগ্রাম, সিলেট, যশোরসহ বিভিন্ন বাণিজ্যিক জেলায় তাদের ডিলার নিয়োগ দেয়া হয়। ভোক্তার চাহিদা মেটাতে সেলাই মেশিনের সংখ্যা ৮টি থেকে ২০টিতে বাড়ানো হয়।

রিয়াজউদ্দিন সাহেবের ছোট ছেলে জনাব সালাউদ্দিন জানালেন সেদিনের কথা, যে ষাটের দশকে একটি রিয়াজ শার্টের সর্বোচ্চ দাম ছিল ১০০ টাকা এবং সমাজের সবচেয়ে ধনী শ্রেণির লোকেরাই এই শার্ট পরতেন। সে সময়ে কোরিয়া, সিঙ্গাপুর ও থাইল্যান্ড ছিল তৈরি পোশাক রপ্তানির ক্ষেত্রে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য নাম। তিন নভোচারীর প্রশংসা পাওয়ার পর রিয়াজউদ্দিন বেশ কয়েকবার করাচিতে যান রিয়াজ শার্ট রপ্তানি করা যায় কিনা সে সুযোগ খুঁজে বের করতে। কিন্তু ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ তার পরিকল্পনাকে থামিয়ে দেয়। তখন চকবাজারের অন্যসব দোকানপাটের সঙ্গে সঙ্গে রিয়াজউদ্দিনের টেইলরিং শপ এবং ফ্যাক্টরিও পাকিস্তানি সেনাবাহিনী পুড়িয়ে দেয়।

স্বাধীনতার পর রিয়াজউদ্দিন নতুন করে তার ব্যবসা শুরু করেন, ১৯৭৩ এ তিনি এর নাম দেন রিয়াজ গার্মেন্টস লিমিটেড এবং স্বাধীন বাংলার প্রথম তৈরি পোশাক কারখানা হিসেবে স্বীকৃতি পান। প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে রিয়াজউদ্দিন তখন ব্যাংকিং ও বাজারজাতকরণ শাখাটি পরিচালনা করতে শুরু করেন এবং কারখানা ও উৎপাদনের দায়িত্ব থাকে মাইজুদ্দিনের হাতে।

এই নতুন আরম্ভের জন্য তারা বেছে নেন এক সৃজনশীল বিজ্ঞাপন। নিজেদের ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ থিমকে ছড়িয়ে দিতে রিয়াজ শার্ট একটি বাইসাইকেল রেসে অর্থায়ন করে। কলকাতার মোহনবাগান ক্লাবের খেলোয়াড়রা যখন বাংলাদেশে আসেন, তাদের রিয়াজ শার্ট উপহার দেওয়া হয়। মোহনবাগানের জনপ্রিয় খেলোয়াড় চুনি গোস্বামির ছবি ও তার প্রশংসাসম্বলিত একটি পোস্টার তখন সংবাদপত্রে ছাপা হয়। নায়করাজ রাজ্জাক হিসেবে পরিচিত কিংবদন্তি অভিনেতা আবদুর রাজ্জাককে রিয়াজ শার্টের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর করা হয়।

১৯৭৬ সালে বাংলাদেশের প্রথম কৃষি ও শিল্প মেলায় রিয়াজ শার্টের একটি প্যাভিলিয়ন দেয়া হয় এবং তা পরিদর্শকদের কাছে বেশ সমাদৃত হয়েছিল। পরের বছর রিয়াজউদ্দিন ট্রেডিং কর্পোরেশন অফ বাংলাদেশ(টিসিবি) এর কাছে রিয়াজ শার্ট রপ্তানি করার ব্যাপারে রাজি করাতে চেষ্টা করেন। বেশিরভাগ কর্মকর্তাদের কাছ থেকেই নিরাশ হয়ে ফিরলেও টেএক্সটাইল মন্ত্রণালয়ের সচিব ইদ্রিস তাকে আশার আলো দেখান। এরপর রিয়াজ শার্টের নমুনা ফ্রান্সে পাঠানো হয়। রিয়াজ পণ্যের উন্নত মান দেখে তারা কিনতে আগ্রহী হন।

এর পরেই রিয়াজউদ্দিনকে উর্দু রোডে দেড় কাঠা জমির উপর তার ফ্যাক্টরি বর্ধিত করতে হয়। সেলাই মেশিনের সংখ্যাও দ্বিগুণ হয় এবং তাকে আরও কর্মী নিতে হয়।

১৯৭৭ সালে, স্বপ্নদ্রষ্টা এই ব্যবসায়ী সেলাইয়ের কাজে মেয়েদের নিয়োগের উদ্যোগ নেন। তার ছেলে সালাউদ্দিন বলেন, ‘আমাদের এলাকায় প্রচুর বেকার নারী ছিল, আমার বাবা চাইছিলেন এসব নারীদের কোনো আয়রোজগারের উৎসের সঙ্গে যুক্ত করতে। শুরুতে বাবা খুব একটা ইতিবাচক সাড়া পেলেন না, পরিবারগুলোর তখন ভয় পাচ্ছিল যে তাদের মেয়েদেরকে চাকরি করতে দিলে পরিবারের সুনাম নষ্ট হবে,’ ছেলে সালাউদ্দিন জানালেন।

সামাজিক এই মতামতের মোকাবেলা করতেই রিয়াজউদ্দিন তার বড়মেয়ে ফাতেমা বেগমকে বুঝিয়েশুনিয়ে রাজি করালেন ফ্যাক্টরিতে কাজ করার জন্য। ফাতেমা তখন মাত্র ম্যাট্রিক পাশ করেছে, বাবার কথায় রাজি হয়ে গেলেন তিনি। মাসে ১০০ টাকা বেতন দেখে আশেপাশের মেয়েরাও আগ্রহী হয়ে উঠল। প্রথমে ৫ জন নারী রিয়াজ গার্মেন্টসে কর্মচারী হিসেবে যোগ দিলেন।

২৮ জুলাই ১৯৭৮ সালে, রিয়াজউদ্দিন ১০ হাজার রিয়াজ শার্ট ফরাসি ক্রেতা হলান্ডার ফ্রঁসের কাছে রপ্তানী করলেন। শার্টের ওই চালানের ফরাসী মুদ্রায় দাম ছিল ১৩ মিলিয়ন ফ্রা, বাংলাদেশী টাকায় যা ছিল ৪ লাখ ২৭ হাজার টাকা। পরের মাসেই খবরের কাগজে রিয়াজউদ্দিনের ছবি ছাপা হল, এক বক্স রিয়াজ শার্ট উপহার দিচ্ছেন টিসিবির চেয়ারম্যান মুনির উজ জামানকে যা একইসঙ্গে তার এগিয়ে যাওয়ার স্মারকও। পরবর্তী সময়ে রিয়াজ গার্মেন্টস ৯ হাজার শার্টের জন্য পুর্নব্যবহারযোগ্য এলসি সুবিধা পেল।

ওই একই বছর রপ্তানির বিপুল সম্ভাবনা দেখে শিল্পপতি নুরুল কাদের খান এবং দক্ষিণ কোরিয়ার দাইয়ু কোম্পানির সঙ্গে মিলে চট্টগামের কালুরঘাটে প্রতিষ্ঠিত করলেন দেশ গার্মেন্টস, যা ছিল দেশের প্রথম শ্ভাতগ রপ্তানিমুখী পোশাক কারখানা।

পরের দুই বছরে আরও তিনটি রপ্তানি অর্ডার পায় রিয়াজ গার্মেন্টস- ৮০ হাজার, ৯০ হাজার ও ১ লক্ষ ১০ হাজার শার্টের অর্ডার। ফ্যাক্টরিতে চার লাইন সিঙ্গারের প্যাডেলসহ পায়ে চালিত মেশিন চালু করা হয়।

১৯৯৮ সালে গাজীপুরের বোর্ডবাজারে তৈরি হয় পাঁচ হাজার শার্ট তৈরির ক্ষমতাসম্পন্ন রিয়াজ এক্সপোর্ট অ্যাপারেল। আর চকবাজারের ফ্যাক্টরির উৎপাদন ক্ষমতা ছিল তিন হাজার। রিয়াজের সঙ্গে তখন ২০০ জন স্থানীয় আর ক’জন দক্ষিণ কোরিয়ান ও শ্রীলঙ্কার টেকনিশিয়ান কর্মরত ছিল। ২০০৮ সাল পর্যন্ত রিয়াজ শার্ট রপ্তানি হয়েছে বিশ্বের দশটিরও বেশি দেশে, যার মধ্যে রয়েছে অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, আয়ারল্যান্ড এবং জার্মানির মত দেশ। তাদের বার্ষিক রপ্তানি আয় গিয়ে দাঁড়ায় ৩০ কোটি টাকায়।

সালাউদ্দিন জানালেন, “রিয়াজ গার্মেন্টস অনেক বেশি পরিমাণে স্কুলের ইউনিফর্ম বানিয়েছে, তাই আমরা ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিতে তেমন যুক্ত হতে পারিনি। বিখ্যাত ব্র্যান্ড জর্জের (যা পরে ওয়ালমার্ট কিনে নেয়) সাথে আমাদের চুক্তি হয়েছিল। প্রতি মাসে আমরা দুই থেকে তিন লাখ পিস স্কুলের ইউনিফর্ম রপ্তানি করেছি।

রিয়াজউদ্দিনের জন্ম ১৯৩৪ সালের ৩ অক্টোবর। তিনি মারা যান ২০০৫ সালের ৫ এপ্রিল। মৃত্যুর সময় তিনি স্ত্রী, দুই কন্যা ও চার পুত্র রেখে গেছেন। রিয়াজউদ্দিনের মৃত্যুর পর রিয়াজ গার্মেন্টস মাত্র তিন বছর টিকে ছিল। এর কারণ ব্যাখ্যা করলেন রিয়াজউদ্দিনের ছেলে সালাউদ্দিন, “আমাদের এক বায়ারের একটি ব্যর্থ প্রজেক্ট এবং দেউলিয়া হয়ে যাওয়ার কারণে আমাদের ওপর দশ কোটি টাকারও বেশি দায় এসে পড়ে। এই বোঝা ভালোমতোই চেপে বসে আমাদের উপর।” তাছাড়া তখনো পর্যন্ত তৈরি পোশাক শিল্পে ব্যাপক ওঠানামা ছিল। রিয়াজ পরিবারের মনে হয়েছিল এই সময়ে সবাই যখন ব্যাংক থেকে বড় বড় ঋণ নিচ্ছে তখন তারা ব্যবসা চালিয়ে যেতে পারবেন না।

“এমনকি জনতা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমিনুল ইসলাম বাড়িতে এসে প্রয়োজনীয় সহায়তা করার আশ্বাস দিলেও আমাদের মা চাননি যে তার সন্তানরা ব্যাংক ঋণ ইত্যাদি নিয়ে সারাক্ষণ শঙ্কিত থাকুক”, জানালেন সালাউদ্দিন। রিয়াজ গার্মেন্টস বন্ধের বিনিময়ে ঋণ শোধ হয়ে যায় তখন। নিজের বংশধরদের রিয়াজউদ্দিন সবসময় পরামর্শ দিয়ে গেছেন ব্যাংকের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখতে, আয় বুঝে ব্যয় করতে এবং মেশিনের যত্ন নিতে ও কর্মীদের যত্ন নিতে।

সালাউদ্দিন বললেন, “আমার বাবা ছিলেন একজন সাধারণ মানুষ। তিনি নিজের ক্ষমতার বাইরে গিয়ে ফ্যাক্টরির প্রসার চাননি। তার খ্যাতির মধ্যে কোন দাগ নেই। তাই তার স্ত্রী চেয়েছিলেন সেটি যেন বজায় থাকে।”

রিয়াজউদ্দিন তৃতীয় শ্রেণীর পরে আর পড়াশোনা করেননি, কিন্তু কেউ তাকে অশিক্ষিত বলতে পারবেনা। তিনি সবকিছুই পড়তে পারতেন। স্মৃতি হাতড়ে সালাউদ্দিন বলেন যে তার বাবা নিজের জন্য প্রাইভেট শিক্ষক রেখেছিলেন ইংরেজি শিক্ষার জন্য। প্রতি রাতেই তাকে দেখা যেত হয় পড়ছেন নয়তো কিছু লিখছেন।

তিনি একজন ভাল সংগঠকও ছিলেন। বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারারস অ্যান্ড এক্সপোর্টারস এসোসিয়েশন রিয়াজউদ্দিনকে তাদের প্রথম বোর্ডের ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করেছিল।

রিয়াজউদ্দিন নিজের সব সন্তানকে নিজের ব্যবসায়ে যুক্ত করলেও বর্তমানে শুধুমাত্র সালাউদ্দিন সেই ধারা বজায় রেখেছেন। বর্তমানে সালাউদ্দিন এএসকে অ্যাপারেল অ্যান্ড টেক্সটাইলস সোর্সিং লিমিটেড নামে একটি বায়িং হাউজ চালান। তিনি ‘বুনন’ নামের একটি টেক্সটাইল বিষয়ক সংগঠন এরও পরামর্শদাতা। রিয়াজ গার্মেন্টস আজ আর নেই, কিন্তু এই পরিবারের কাছে এখনো তার লাইসেন্সটি রয়ে গেছে।

“যদি আল্লাহ চায়, আমি হয়তো আবারও কোনো একদিন রিয়াজ শার্ট এর উৎপাদন শুরু করবো” বলে ইতি টানেন সালাউদ্দিন।  লেখার এই অংশটুকুর কৃতজ্ঞতা : দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড পত্রিকা।

বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের জয় যাত্রায় দেশ গার্মেন্টস নুরুল কাদের এর অবদান, উত্থান, বিকাশ এবং সংকুচিত হওয়ার বিশ্লেষণ কেন জরুরী।

১৯৭৯ সালে দেশ গার্মেন্টস লিমিটেড প্রথম যৌথ উদ্যোগে নন-ইকুইটি ফার্ম প্রতিষ্ঠা করে। দেশ গার্মেন্টস ও দক্ষিণ কোরিয়ার দায়েয়ু কর্পোরেশনের মধ্যে প্রযুক্তিগত এবং বাজারজাতকরণে সহযোগিতার সম্পর্ক স্থাপিত হয়। প্রথম দিকে মেশিনে কাজ করার মতো উপযোগী করে তোলার জন্য শ্রমিকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। পরে পরিদর্শকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ৩ জন মহিলাসহ ১২০ জন পরিচালক (মেশিন) দক্ষিণ কোরিয়ায় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হয় এবং এই প্রশিক্ষণপ্রাপ্তরাই ১৯৮০ সালে উৎপাদন শুরু করে। এটা ছিল প্রথম শতভাগ রপ্তানিমুখী কোম্পানি।

বাংলাদেশের গার্মেন্টসের পথিকৃৎ দেশ গার্মেন্টস এর উদ্যোক্তা জনাব নুরুল কাদের কে নিয়ে ব্যক্তিগত ভাবে বিভিন্ন পত্র পত্রিকা পাঠ করে যতটুকু জানতে পেরেছি তার কিছু অংশ তুলে ধরার চেষ্টা করছি।

জাতীয় অধ্যাপক ও ইতিহাসবিদ জনাব সালাহ্উদ্দিন আহেমদ ২০১৩ সালে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন, ১৩ সেপ্টেম্বর বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা, সাবেক সচিব ও বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্পের পথিকৃৎ মোহাম্মদ নুরুল কাদের খানের ১৫তম মৃত্যুবার্ষিকী। তার ডাকনাম ঝিলু। তাকে আমি চিনতাম তার ছাত্রজীবন থেকেই। সে ছিল আমার শ্রদ্ধাভাজন সহকর্মী ও বিশেষ বন্ধু প্রয়াত ড. এ আর মল্লিকের শ্যালক। ড. মল্লিক ছিলেন এদেশের খ্যাতিমান শিক্ষাবিদ, ইতিহাসের প্রবাদপ্রতিম অধ্যাপক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা ভিসি, সাবেক অর্থমন্ত্রী-সর্বোপরি দেশ-বিদেশে স্বাধীনতা যুদ্ধের আলোচিত একজন সংগঠক। আমি মল্লিকের বাসায় নিয়মিত আসা-যাওয়ার কারণে ঝিলুর সাথে ঘনিষ্ঠতা বাড়ে।

ঝিলু ছিল সুদর্শন, অত্যন্ত মেধাবী, তীক্ষ বুদ্ধিসম্পন্ন, বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী একজন মানুষ।

কলেজ জীবন শেষে ঝিলু পাকিস্তান বিমান বাহিনীর জিডি পাইলট হিসেবে যোগদান করে স্বাস্থ্যগত কারণে পরে ফিরে আসে। ফিরে এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বি. কম-এ ভর্তি হয়। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে সক্রিয় ছাত্র রাজনীতিতে যুক্ত হয়ে ঝিলু ফজলুল হক মুসলিম হলের ছাত্র সংসদের ভিপি পদে নির্বাচিত হয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয় পর্ব শেষ করে ঝিলু পাকিস্তান সেন্ট্রাল সুপিরিয়র (সিএসপি) পরীক্ষায় কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হয়ে বর্ণাঢ্য কর্মজীবন শুরু করে। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন জায়গায়, সরকারি গুরুত্বপূর্ণ পদে চাকরি করে বিচিত্র অভিজ্ঞতা অর্জন করে।

প্রশাসনিক বিষয়ে উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য সে প্রায় বছরাধিককাল ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে অবস্থান করে। সে সময় আমি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসাবে কর্মরত। ক্যামব্রিজে যাওয়ার পূর্বে হঠাত্ করে ঝিলু একদিন আমার বাসায় এসে, তার সবচেয়ে প্রিয় সম্পদ দেশের প্রখ্যাত শিল্পী মোহাম্মদ কিবরিয়া, কামরুল হাসান, মর্তুজা বশির প্রমুখের আঁকা ২৫টি দুর্লভ ছবি রেখে যায়। অত্যন্ত দৃষ্টিনন্দন সে ছবিগুলো আমাকে দিয়ে বললো, সালাউদ্দিন ভাই আমি ছবিগুলো অন্য কোথাও রাখতে ভরসা পাচ্ছি না! এগুলো আপনার জিম্মায় রেখে গেলাম। আমি বিদেশ থেকে ফিরে এসে আপনার কাছ থেকে নেব। পরে বাছাই করে ৩টি ছবি আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক ভবনে টাঙিয়ে রাখি। বাকি ছবিগুলো সযত্নে চট দিয়ে মুড়িয়ে প্যাকেট করে বাসার দোতলার স্টোর রুমে রেখে দিয়েছিলাম। বছরখানেক পর ঝিলু ফিরে এসে ছবিগুলো পাবনায় নিয়ে যায়। সে তখন পাবনার জেলা প্রশাসক।

মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে নুরুল কাদেরই একমাত্র জেলা প্রশাসক মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রথম প্রহর থেকে সক্রিয়ভাবে অংশ নেয়। তার নেতৃত্বে পাবনার পুলিশ, আনসার, রাজনৈতিক নেতাকর্মী, মুক্তিপাগল সাধারণ মানুষ সংগঠিত হয়ে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীকে পরাস্ত করতে যুদ্ধ করেছে। তার নেতৃত্বে পাবনার বিভিন্ন স্থানে ১৭টি খণ্ডযুদ্ধ সংঘটিত হয়। ১৯৭১ সালের ৩০ মার্চ স্বাধীন বাংলাদেশের নামাঙ্কিত রাবার সীল ব্যবহার করে সরকারি কর্মকাণ্ড শুরু করে। পাশাপাশি আয়ত্তাধীন এলাকার ব্যাংকের স্থানীয় শাখাকে জমাকৃত সকল টাকা সরকারের নিকট জমা দেয়ার নির্দেশ দেয়। ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের বৈদ্যনাথ তলায় মুজিবনগর সরকারের মন্ত্রিসভার শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের সার্বিক দায়িত্ব পালন করে। পরে সংগৃহীত টাকা তালিকাসহ প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ এর নিকট হস্তান্তর করে। পরবর্তীতে ঐ টাকাটাই প্রবাসী সরকার পরিচালনার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। পাকিস্তান বাহিনীর প্রবল আক্রমণে প্রতিরোধ ভেঙে পড়ার সময় সকল যোদ্ধাকে নিয়ে ট্রেনে তুলে, সেই ট্রেন নিয়ে বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে ভারতীয় সীমান্ত পেরিয়েছিলো।

ঝিলু প্রবাসী গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রথম সচিব ও স্বাধীনতার পর প্রথম সংস্থাপন সচিবের দায়িত্ব পালন করেন বিশ্বস্ততা ও দক্ষতার সাথে। পরবর্তীতে সরকারি চাকরি ছেড়ে দিয়ে ব্যবসায় নিজেকে নিয়োজিত করে। সেটাও ছিল নতুন ধারার ব্যবসা। এদেশ থেকে গার্মেন্টস পণ্য তৈরি ও রপ্তানির ব্যবসা। বাংলাদেশের গার্মেন্টস বাণিজ্য শুরু তারই হাত দিয়ে। তারই বদৌলতে আমরা দেখছি এদেশের গার্মেন্টস শিল্পের প্রসার। ঝিলু এই ব্যবসাটিকে শিল্প হিসাবে গড়ে তোলার জন্য কোরিয়ার বিখ্যাত দ্যাইয়ু কর্পোরেশনের সহযোগিতায় সম্পূর্ণ নিজস্ব ব্যক্তি উদ্যোগে ১৩০ জনের একটি টিমকে প্রশিক্ষণ দিয়ে দেশে ফিরিয়ে আনে। আর এই প্রশিক্ষিত টিমের মাধ্যমেই বাংলাদেশে অত্যাধুনিক গার্মেন্টস টেকনোলজী প্রবেশ করে। ঝিলু ছিল একজন বিরাট হূদয়বান মানুষ। সমাজসেবামূলক কাজে তার অবদান অনস্বীকার্য। তার অবদান তাকে স্মরণীয় করে রাখবে-বহুকাল, বহুদিন।

শ্রদ্ধেয় আনিসুজ্জামান স্যার : লেখক ও শিক্ষাবিদ। ইমেরিটাস অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। তিনি ২০১৩ সালে জনাব নুরুল কাদের কে নিয়ে দারুণ এক স্মৃতিচারণ লিখেছিলেন।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে নির্মিত নাইন মান্থস টু ফ্রিডম চলচ্চিত্রটি যাঁরা দেখেছেন, তাঁদের নিশ্চয় মনে পড়বে, ছবির শুরুতেই ভেসে ওঠে সামরিক পোশাকসজ্জিত শ্মশ্রুমণ্ডিত এক তরুণের বুদ্ধিদীপ্ত মুখ এবং সেই মুখ থেকে চ্চারিত প্রথম বাক্য: আই অ্যাম নূরুল কাদের। এই আত্মপরিচয়দানের মধ্যে যে সুরটি বেজেছিল, তা গভীর ত্মপ্রত্যয়ের—যেন সে বলতে চাইছে, আই অ্যাম দ্য নূরুল কাদের—নূরুল কাদের নামে আছে অনেকে, কিন্তু আমি আমিই।

আত্মপ্রত্যয় ছিল নূরুল কাদেরের আজীবনের প্রধান বৈশিষ্ট্য, তা অনেককে কাছে টানত—কাউকে কাউকে দূরেও ঠেলে দিত। আমাকে সে কাছে টেনেছিল। প্রথম দর্শনে নূরুল কাদেরের প্রতি আমি আকৃষ্ট হয়েছিলাম তার অনিন্দ্যসুন্দর কান্তিতে, রুচিশীল পোশাকে, অনুপম বাকভঙ্গিতে এবং সর্বোপরি তার আত্মপ্রত্যয়ের অভিব্যক্তিতে।

যত দূর জানি, নূরুল কাদের খান ঝিলু আরমানিটোলা হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করেছিল ১৯৫০ সালে। তারপর ঢাকা কলেজ থেকে ১৯৫২ সালে ইন্টারমিডিয়েট পাস করে সে যোগ দিয়েছিল পাকিস্তান বিমানবাহিনীতে। বছর খানেকের মধ্যেই স্বাস্থ্যগত বা অন্য কোনো কারণে অযোগ্য ঘোষিত বা ছাঁটাই হয়ে সে ফিরে এসেছিল। তখন ভর্তি হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিকম ক্লাসে। সে ছিল ফজলুল হক মুসলিম হলের আবাসিক ছাত্র। আমি সদ্য শিক্ষকতায় ঢুকেছি—ঝিলু একদিন জানাল যে সে সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা দেবে। তার পরীক্ষায় একটা বিষয় বাংলা, কিন্তু বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস পড়ার মতো সময় তার নেই। আমাকে ও বিষয়ে সারকথাগুলো বলতে হবে, সে শুনে নেবে। তথাস্তু। ঝিলু আমার বিছানায় কাত হয়ে শুয়ে থাকত—কখনো কখনো চোখ বন্ধ করে। বিছানার ধারে চেয়ার টেনে বসে আমি নিজের মতো বলে যেতাম। সে কোনো লেখালেখির মধ্যে যেত না। চার অধিবেশনে বোধ হয় আমাদের কাজ শেষ হয়েছিল। শ্রুতিধরের মতো মূল কথাগুলো সে মনের মধ্যে ধরে নিয়েছিল। পরে আমাকে বলেছিল, বাংলায় সে অনেক নম্বর পেয়েছে। এই কৃতিত্বে আমার একটা ভাগ ছিল হয়তো, কিন্তু অধিকাংশ ঘটেছিল তার গুণে।

ঝিলু পরীক্ষা দিয়েছিল বোধ হয় ১৯৬০ সালে সিভিল সার্ভিসে। চূড়ান্তভাবে প্রবেশ করতে করতে ১৯৬১ সালে হয়ে যায়। এরপর তার সঙ্গে যোগাযোগ অনিয়মিত হয়ে পড়ে। মাঝে মাঝে মহকুমা প্রশাসক বা অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক হিসেবে তার উৎকেন্দ্রিকতার কিছু গল্প শুনতাম। সাক্ষাৎ হলে ঝিলু তার সদ্য পড়া কোনো বই বা সদ্য দেখা কোনো চলচ্চিত্রের গল্প করত। তারপর আমি চলে গেলাম চট্টগ্রামে। তার সঙ্গে একেবারেই আর দেখা হতো না, তবে ড. মল্লিক যেহেতু চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর, তাই তাঁর বা ভাবির কাছ থেকে ঝিলুর খবর পাওয়া সহজ ছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময় অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে, কিছুদিন আগরতলায় কাটিয়ে, কলকাতায় এসে পৌঁছাই মে মাসের মধ্যভাগে।

ঝিলু তখন রীতিমতো বীর। শুনলাম, পাবনার জেলা প্রশাসক হিসেবে সেখানে সে পাকিস্তানি সেনাদের প্রতিরোধ-সংগ্রামের নেতৃত্ব দিয়েছে। জেলখানা খুলে দিয়ে সে কয়েদিদের মুক্ত দিয়ে তাদের আহ্বান জানিয়েছে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে; সরকারি অস্ত্রাগার থেকে অস্ত্র বের করে দিয়েছে জনে জনে; ট্রেজারির টাকা সরিয়েছে বাংলাদেশ সরকারের জন্য। প্রতিরোধ ভেঙে পড়ার সময় সকল যোদ্ধাকে ট্রেনে তুলে নিয়ে সেই ট্রেনে বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে, সীমান্ত পেরিয়ে চলে এসেছে ভারতে। বাংলাদেশ সরকার গঠিত হওয়ার পরে সে হয়েছে প্রথম সংস্থাপনসচিব। এত দিন পরে দেখা হওয়ার উল্লাস: উচ্ছ্বাস কাটার পরে জানলাম, ঘাতক পাকিস্তানিদের প্রতি ঘৃণাবশত সে নিজের নামের শেষাংশ খান ছেঁটে দিয়েছে, আর প্রতিজ্ঞা করেছে, দেশ স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত গোঁফদাড়ি কামাবে না।

ঝিলু আজন্ম আশাবাদী। মুক্তিযুদ্ধের সময় তাই তার সঙ্গে কথা বলে আরও একধরনের আরাম পাওয়া যেত। আমার কথায় আমার বন্ধুর অগ্রজকে আগরতলা থেকে মুজিবনগরে সে বদলি করে এনেছিল।

প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের প্রতি তার মনে গড়ে উঠেছিল অশেষ শ্রদ্ধা। জনকণ্ঠে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত তার ‘আমার একাত্তর’ নামক রচনায় তার পরিচয় আছে, আর সে সময়ে তার অভিজ্ঞতার বিশ্বস্ত বর্ণনা আছে। ওই লেখা প্রকাশ পেতে শুরু করলে তাকে যখন বললাম, ওই একই নামে আমিও লিখেছি, সে বিন্দুমাত্র বিচলিত না হয়ে বলল, তাই নাকি? তা বেশ তো। তোমার আমার একই নামের বই থাকবে। মুক্তিযুদ্ধের সময় ঝিলু হাড়ভাঙা পরিশ্রম করেছিল, দেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও তাই। তবে স্বাধীন দেশে সে নানা বিরোধে জড়িয়ে পড়েছিল। কেউ অভিযোগ করলেন, ‘মুজিবনগরী’ নূরুল কাদের দেশে রয়ে যাওয়া সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেছেন; আবার দেখা গেল, মুক্তিসংগ্রামী আরেক সচিবের সঙ্গেও প্রকাশ্যে তার ঝগড়া হয়ে গেল।

সে বিয়ে করল ১৯৭৩ সালে, সংসারী হলো, কিন্তু সরকারি কাজে নিজেকে আর মানিয়ে নিতে পারল না। চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে ঝিলু করল পোশাকশিল্পের প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশ পোশাকশিল্প আজ যে নানা দিক দিয়ে উল্লেখযোগ্য, সেই শিল্পক্ষেত্রে নূরুল কাদেরের ভূমিকা পথিকৃতের। তার মনটা বড় ছিল। ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন ও আমি একবার এক সৎ কাজের জন্য চাঁদা তুলতে দেশ গার্মেন্টস অফিসে তার কাছে গিয়ে আমাদের উদ্দেশ্য ব্যক্ত করলাম। ঝিলু আমাকে জিজ্ঞেস করল, ‘আমার জন্য কত ধরেছ?’ বললাম, ‘৫০ হাজার।’ সে তার সচিবকে ডেকে কী বলল। আমাদের কফি খাওয়া শেষ হতে সচিব তার হাতে একটা প্যাকেট দিয়ে গেলেন। সেটা সে দিল আমাকে। তার মধ্যে ৫০০ টাকার ১০০ নোট।

হয়ত ভাবছেন এই সব আলোচনা কেন গার্মেন্টসের উত্থান পতনের আলোচনার মাঝে প্রবেশ করল। আমি অনেকদিন থেকেই এই মানুষ গুলোর ব্যাপারে চরম অনুসন্ধিৎসু। কি পরিমান যোগ্যতা, দক্ষতা, মানসিকতা ও নেতৃত্বের গুণাবলী সম্পন্ন হলে একজন মানুষ একটা দেশের ইতিহাস বদলে দিতে পারে তা গবেষণা করে বের করা দরকার।

প্রথাগতভাবে একটি জাতির ইতিহাস মূলত রাজনৈতিক। তবে তার অনুষঙ্গ অবশ্যই থাকবে অর্থনীতি, সমাজ, সংস্কৃতি ও অন্যান্য উপাদান। আমাদের ধনধান্য পুষ্পভরা দেশটির ইতিহাসও একই ধারায় চলমান। আর তা চলছে কারও লিপিবদ্ধ করার কোনো প্রত্যাশা না করে এবং নিজস্ব নিয়মে। এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে আমাদের অজান্তেও। তেমনি একটি বিষয় বাংলাদেশের অর্থনীতির বিকাশ। একাত্তর থেকে এ পর্যায়ে অর্থনীতির বিকাশ কীভাবে হলো আর কাদের প্রচেষ্টায়, সেটার অনেকটাই অজানা থেকে যাচ্ছে বর্তমান প্রজন্মের কাছে।

আমাদের প্রধান রপ্তানি পণ্য তৈরি পোশাক। আজ তার রপ্তানি মূল্য ৩৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এ শিল্পে নিয়োজিত মানুষের সংখ্যা প্রায় ৪০ লাখ। তাদের শতকরা ৮০ ভাগ নারী। তৈরি পোশাকশিল্পের এই সাফল্য নিঃসন্দেহে বিস্ময়কর। গার্মেন্টস শিল্পের বদৌলতে ফরওয়ার্ড ও ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ শিল্পের মতো অন্য অনেক শিল্প ও বাণিজ্যের প্রসার ঘটেছে। এর সুফলভোগী গোটা অর্থনীতি ও সমাজ। কিন্তু কীভাবে আমরা গার্মেন্টস শিল্পের সূচনা করেছি, তার ইতিহাস জানেন কজন। এমনকি যাঁরা এর সুফলভোগী, তাঁদেরও নগণ্যসংখ্যকই খবরটি রাখেন। আর রাখার প্রয়োজনও অনুভব করেন না অনেকেই।

এটা আমাদের দেশ ও সমাজের দুর্ভাগ্যও বটে।  Bangladesh Garments Industry

১৯৭৪ সালে বিশ্বের টেক্সটাইল বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণে মাল্টিফাইবার অ্যাগ্রিমেন্ট কতিপয় পদক্ষেপ নেয়। এতে উন্নয়নশীল কিছু দেশ তাদের শিল্পপণ্য শিল্পোন্নত দেশে পাঠানোর কোটা লাভ করে। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের আর্থসামাজিক অগ্রগতির বরপুত্র নুরুল কাদেরের দৃষ্টিতে বিষয়টি এড়িয়ে গেল না। নতুন দিগন্ত উন্মোচনে এ সুযোগকে তিনি কাজে লাগাতে চাইলেন। ১৯৭৮-৭৯-এর দিকে কোরিয়ার দাইয়ু করপোরেশনের সঙ্গে এক সমঝোতার মাধ্যমে তিনি এ দেশের গার্মেন্টস শিল্প তৈরির ভিত রচনা করলেন। দরকার শিক্ষিত জনবল। প্রথমে দাইয়ুর সহায়তায় ১৩০ জন সুপারভাইজার/ম্যানেজারকে তিনি কোরিয়ায় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন। এরপর এই কর্মী বাহিনী নিয়ে চট্টগ্রামের কালুরঘাটে আন্তর্জাতিক মানের কারখানা দেশ গার্মেন্টস চালু করেন। পুঁজি বলতে দক্ষতা, দৃঢ়তা আর সামান্য অর্থ। কিন্তু স্বপ্নের বিস্তৃতি ছিল দিগন্তপ্রসারী। আর এ স্বপ্নের সফল বাস্তবায়নও আমরা দেখছি। ৪১০ বিলিয়ন ডলারের গার্মেন্টস পণ্যের আন্তর্জাতিক বাজারে আমরা ইতিমধ্যে ৫ শতাংশ দখলে নিয়ে দ্বিতীয় স্থানে অবস্থান করছি। আর সূচনায় যে ১৩০ জন কর্মী প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন, তাঁদের অধিকাংশই আজ এক বা একাধিক গার্মেন্টস শিল্পের মালিক।

নুরুল কাদের স্বপ্ন দেখতেন এ শিল্প একপর্যায়ে দেশের প্রধান রপ্তানি খাত ও কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে পরিণত হবে। আর ইতিমধ্যে তা হয়েছেও। তারপরও থেমে নেই। আকাশ আজ তাদের সীমা। তাঁরই প্রচেষ্টায় গার্মেন্টস শিল্পে এল বড় রকম প্রণোদনা। এর প্রধানতম হচ্ছে উৎপাদিত পণ্যের কাঁচামাল আমদানি প্রক্রিয়া সহজীকরণ। ব্যাক টু ব্যাক এলসি আর বন্ডেড ওয়্যারহাউসের চিন্তা তিনিই করেন। এটা বাস্তবায়নেও সরকারকে সম্মত করাতে সক্ষম হয়েছিলেন তিনি। বলা হয় পরোক্ষভাবে তিন কোটি লোকের জীবিকা এ খাতের ওপর নির্ভরশীল।

বাংলাদেশের আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে তুলনামূলক কম সময়ে বিস্ময়কর অবদান রাখছে গার্মেন্টস খাত। যেকোনো কিছুর সূচনাতে আলোকবর্তিকাবাহী কেউ না কেউ থাকেন। এ ক্ষেত্রে ছিলেন নুরুল কাদের, একক ও অদ্বিতীয়। ইতিহাসের প্রয়োজনে যদি ব্যক্তির আবির্ভাব হয়, তবে ইতিহাসের সেই প্রয়োজনেও তিনি সময়োচিত সাড়া দিয়ে এর গৌরবোজ্জ্বল অংশীদার হয়েছেন। হয়েছেন ইতিহাসের মেধাবী কারিগর।

চট্টগ্রামের কর্ণফুলী তীরবর্তী কালুরঘাট বিসিক শিল্প এলাকা। যেথানে গ্রথিত রয়েছে বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রধান চালিকাশক্তি হিসেবে রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক শিল্পের সূতিকাগার। দক্ষিণ কোরিয়া থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে আসা বাংলাদেশের ১৩০জন কর্মী দিয়ে ৪২ বছর আগে দেশে প্রথম আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন পোশাক তৈরির সূচনা হয়েছিল এখান থেকেই। নানা ঘাত প্রতিঘাত পেরিয়ে আজও স্বমহিমায় উজ্জ্বল সেই প্রতিষ্ঠানটি। দেশের প্রথম শতভাগ রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক কারখানা ‘দেশ গার্মেন্টস’

কালুরঘাট শিল্প এলাকায় ৯ দশমিক ৩ একর জায়গা নিয়ে রয়েছে এ প্রতিষ্ঠানটির অবস্থান। সেখানে একটি একতলা ভবনের ৮০ হাজার বর্গফুটের একটি ফ্লোরেই একসঙ্গে কাজ করেন এক হাজার শ্রমিক। কারখানাটিতে বছরে ৩৬ লাখ পিস শার্ট তৈরির সক্ষমতা রয়েছে। কারখানার ভেতরে ঢুকে দেখা গেল, সবাই নিজ নিজ কাজ করে যাচ্ছেন নীরবে। বিভিন্ন রঙের শার্ট তৈরির কাজ চলছে সেখানে বিরামহীনভাবে। কারখানার সামনে বিশাল পুকুর, পাশে সবুজ মাঠ। আশপাশের গাছগাছালিতেও সবুজের সমাহার। দেশের প্রথম পোশাক রপ্তানির কৃতিত্বের অধিকারী প্রতিষ্ঠানটির বিশাল আঙিনায় ঢুকেই দেখা গেল এমন মনোরম দৃশ্য।

দেশ গার্মেন্টসের প্রতিষ্ঠাতা নুরুল কাদের খানের একমাত্র মেয়ে ভিদিয়া অমৃত খান বর্তমানে উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে গার্মেন্টস টির দেখাশোনা করছেন। পিতার স্মৃতি, ভিশন, গার্মেন্টস প্রতিষ্ঠা, ব্যাক টু ব্যাক এলসি পদ্ধতি চালু, কারখানা পর্যায়ে বন্ডেড ওয়্যার হাউজ নিয়ে যাওয়া, পিতার চিন্তা-চেতনা, দেশ গার্মেন্টসের বর্তমান অবস্থান ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলেন তিনি।

দেশের প্রথম শতভাগ পোশাক রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের শুরুর কথা বলতে গিয়ে ভিদিয়া অমৃত খান বলেন, নুরুল কাদের খান ছিলেন একজন দেশপ্রেমিক বীর মুক্তিযোদ্ধা। মুজিবনগর সরকারের সংস্থাপন সচিব ছিলেন তিনি। চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পর তিনি তৈরি পোশাক কারখানা করার উদ্যোগ নেন। কিন্তু এ খাতের কাজের বিষয়ে কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না তার নিজের কিংবা নিয়োগকৃত শ্রমিকদের। ১৯৭৭ সালে আব্বার সঙ্গে পরিচয় হয় দক্ষিণ কোরিয়ার দাইয়ু করপোরেশনের প্রেসিডেন্ট মি. কিম-এর সঙ্গে। এরপর তৈরি পোশাক কারখানার বিষয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণের জন্য বাংলাদেশ থেকে ব্যবস্থাপনা সংশ্লিষ্ট ও শ্রমিক মিলে মোট ১৩০ জনকে দক্ষিণ কোরিয়ায় প্রশিক্ষণের জন্য দাইয়ু করপোরেশনের সঙ্গে চুক্তি হয়। এরপর তাদের দক্ষিণ কোরিয়ার ‘পুসান’-এ দাইয়ু’র পোশাক কারখানায় প্রশিক্ষণের জন্য পাঠানো হয়। কাটিং, সুয়িং, ফিনিশিং, মার্কেটিং, ফিন্যানশিয়াল, কমার্শিয়াল সবকিছুর ওপর প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় তাদের। ছয় মাস প্রশিক্ষণ শেষে দেশে ফেরেন তারা। এরপর তাদের দিয়ে যাত্রা শুরু হয় দেশ গার্মেন্টসের।

দেশ গার্মেন্টসের বিভিন্ন সময়ের প্রতিকূল পরিস্থিতির কথা উল্লেখ করে এর প্রতিষ্ঠাতার কন্যা ভিদিয়া অমৃত খান বলেন, ১৯৮৭ সালে আব্বার শরীরে ক্যানসার ধরা পড়ল। আমি ছোট ছিলাম। সবকিছু এখানে ফেলে রেখে আব্বার চিকিৎসার জন্য আমাদের পুরো ফ্যামিলি চলে গেল যুক্তরাজ্যে। উনার চিকিৎসার জন্য প্রায় দুই বছর আমাদের ওখানে থাকতে হলো। ১৯৮৯ সালে আমরা দেশে ফিরে এলাম। তখন দেখতে পাই ফ্যাক্টরিটি আগের অবস্থায় নেই। অনেকটা বিপর্যস্ত অবস্থায় ফাক্টরিটি পেলাম। এরপর ১৯৯১ সালে হলো ঘূর্ণিঝড়। ওই সময় আমাদের কারখানার সবকিছু শেষ হয়ে গেল। এখানে কোমর পর্যন্ত পানি। লোনা পানিতে নষ্ট হয়ে গেল সব মেশিনারিজ। তখন আমরা ব্যাংকিং করতাম বিসিসিআই-এর সঙ্গে। ওই সময় ব্যাংক থেকে ইন্স্যুরেন্সের কোনো টাকা পাইনি। তাই ফ্যাক্টরিটা তখন আর চালু রাখা সম্ভব হয়নি। ১৯৯৬ সালে নতুনভাবে মেশিনপত্র কিনে আব্বা আবার কারখানা চালু করলেন। ১৯৯৮ সালে তিনি মারা গেলেন। এরপর থেকে আমাদের ফ্যামিলি আব্বার এই স্মৃতি চালু রেখেছি। আমার মা এখন দেশ গ্রুপের চেয়ারম্যান, বড় ভাই ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং আমি উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দেশ গার্মেন্টসসহ গ্রুপের অন্য প্রতিষ্ঠানগুলো চালাচ্ছি।

ব্যাক টু ব্যাক এলসি পদ্ধতি ও কারখানা পর্যায়ে বন্ডেড ওয়্যার হাউস সিস্টেম নুরুল কাদের খানের অবদান বলে উল্লেখ করে ভিদিয়া অমৃত খান বলেন, প্রতিষ্ঠালগ্নে দেশ গার্মেন্টসে বাংলাদেশ ব্যাংক যে ফাইনান্সিং করার কথা ছিল, তখন ব্যাংক ওই পরিমাণ টাকা দিতে পারেনি। তখন আব্বা বললেন, শতভাগ কাঁচামাল মালিক নিজেরা কিনে তো কারখানা চালানো সম্ভব হবে না। তখন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ছিলেন আব্বার বন্ধু নুরুল ইসলাম সাহেব। তখন উনার সঙ্গে কথা বলে আব্বা ব্যাক টু ব্যাক এলসি সিস্টেম চালু করাতে সক্ষম হন। এটা আব্বার সৃষ্টি এবং অবদান। এ ফাইন্যান্সিং সিস্টেম যদি তখন না হতো তাহলে গার্মেন্টস শিল্প আজ এতদূর এগিয়ে আসতে পারত না। উনার আরেকটা অবদান ছিল বন্ডেড ডিউটি ফ্রি ওয়্যার হাউস সিস্টেম। এ সিস্টেম চালু না হলে বাংলাদেশের পোশাক শিল্প কোনোভাবেই প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারত না। তখন এ শিল্পের এতটা বিকাশ হতো না। যখন কোটা সিস্টেম শুরু হলো তখন তিনি দুই বার আমেরিকা এবং কানাডায় কোটার বিষয়ে নেগোশিয়েশন করতে গিয়েছিলেন। দুইবারই সফলভাবে দেশের জন্য কোটা নিয়ে এসেছিলেন। এটা হচ্ছে বাংলাদেশের অর্থনীতি ও পোশাক শিল্পে দেশ গার্মেন্টসের অবদান।

তিনি আক্ষেপ করে বলেন, আব্বা ব্যবসায়ী ছিলেন না, একজন ভিশনারির মতো ছিলেন। উনি নিজে বড়লোক হওয়ার চিন্তা করেননি। বিদেশে আমাদের দশটা বাড়িও নাই, দশটা অ্যাকাউন্টও নাই। একজন দেশপ্রেমিক নাগরিক, একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আব্বা চেয়েছিলেন বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে যাক। কিন্তু এখন তো দেখা যায়, অনেককে ভিআইপি সিআইপি বানানো হয় কিন্তু যে মানুষটি দেশের অথনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য এত কাজ করেছেন তার কথা আর কারও মনে নেই।

আজিম মান্নান গার্মেন্টস।

আমাদের পোশাক রপ্তানী শিল্পের আর এক স্মরণীয় নাম হল আজিম মান্নান গার্মেন্টস। একজন হলে সানম্যান গ্রুপের কর্ণধার মেজর (অব:) মান্নান, আরেকজন হলেন মোহাম্মদ ফজলুল আজিম (জন্ম : ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৫) একজন বাংলাদেশী শিল্পপতি, ব্যবসায়িক উদ্যোক্তা ও প্রাক্তন রাজনীতিবিদ। তিনি পোশাক খাতের উদ্যোগ আজিম গ্রুপের চেয়ারম্যান। তিনি জাতীয় সংসদের সংসদ সদস্য ছিলেন ।

জাতীয় সংসদে সেই মেয়াদে সংসদে একমাত্র স্বতন্ত্র আইনজীবী ছিলেন আজিম। আজিম গ্রুপের এখন ২৩ টি গার্মেন্টস কারখানা এবং ৩ টি ব্যাকওয়ার্ড লিঙ্কেজ কারখানা রয়েছে। আজিম গ্ৰুপ হংকংয়ের সোর্সিং এবং মার্কেটিং হাব এবং নিউইয়র্ক সিটির একটি লিয়াসন অফিস স্থাপন করে বিদেশেও তার ব্যবসায়ের প্রসার ঘটিয়েছেন। আজিম গ্রুপের প্যাকেজিং এবং কাগজের ব্যবসাও রয়েছে। সংস্থার একটি কারখানা রয়েছে যা তার পণ্যগুলির প্যাকেজিংয়ের জন্য কার্টন এবং কাগজ তৈরি করে।

মোহাম্মদ ফজলুল আজিম বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) সহ-সভাপতি হিসাবেও দায়িত্ব পালন করেছেন দেশের তৈরি পোশাক শিল্পকে নেয়ার জন্য তার অবদান অনেক।

মেজর মান্নান বাংলাদেশের একজন রাজনীতিক ও শিল্পোদ্যক্তা। ১৯৪২ সালে নোয়াখালী জেলার সোনাপুরের দক্ষিণের চর শুল্যকিয়া ইউনিয়নের ইসহাক পুর গ্রামে জন্ম নেন। তিনি নোয়াখালী জিলা স্কুল থেকে মাধ্যমিক এবং ফেনী কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পড়াশোনা শেষ করেন। এরপর তিনি পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী তে যোগদান করেন।

১৯৬২ সালে তিনি পাকিস্তান সামরিক শিক্ষালয় থেকে ডিগ্রি পাস করেন। তাঁর কর্মজীবন শুরু হয়েছিল সেনাবাহিনীতে চাকুরীর মাধ্যমে। রক্তক্ষয়ী ১৯৭১ এরপর তিনি পাকিস্তান সামরিক বাহিনী ছেড়ে বাংলাদেশ সামরিক বাহিনীতে যোগদান করেন।তিনি ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহন করেন। ১৯৭৪ সালে সামরিক বাহিনী থেকে অবসর গ্রহণ করে। পরবর্তীতে তিনি ১৯৮০’র দশকে পোশাক কারখানা স্থাপনের মাধ্যমে বিশেষ সাফল্য লাভ করেন। আজিম মান্নান গার্মেনস নামে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান শুরু করেন, বর্তমানে সানম্যান গ্রপ নামে পরিচিত।

এ গ্রুপের প্রতিষ্ঠানগুলো হলো সানম্যান সোয়েটার, ড্রেসকো লিমিটেড, পাইওনিয়ার ড্রেসেস, সেরিনা গার্মেন্টস অ্যান্ড টেক্সটাইল লিমিটেড, কাশেম সি হোয়েন কোম্পানি, ইয়াকুব গার্মেন্টস, হংকং

ডেনিমস, সানম্যান স্পিনিং, সান গ্লোরি, সানকিট টেক্সটাইল, পেনিনসুলা গার্মেন্টস, বাংলালায়ন, সানম্যান পেপার ক্যাপিটাল, সানপ্যাক ইন্ডাস্ট্রিজ, গ্লোরি ইন্ডাস্ট্রিজ, সানম্যান টেক্সটাইল, সানফ্লাওয়ার লাইফ ইন্স্যুরেন্স, ইস্টার্ন ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি, গোল্ডেন হরাইজন, ডেল্টা ফ্যাশন ও আলফা টেক্সটাইলসহ প্রায় ৪০টি প্রতিষ্ঠান।

জানা গেছে, কমপ্লায়েন্স ব্যবস্থাপনা, ধারাবাহিক শ্রম অস্থিরতা, ক্রয়াদেশ সংকটসহ নানাবিধ কারণে লোকসান গুনতে হচ্ছে সানম্যান গ্রুপের পোশাক কারখানাগুলোকে। এ প্রেক্ষাপটে একে একে পোশাক কারখানার ইউনিটগুলো বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিপুল পরিমাণ লোকসান হচ্ছে জেনেও পোশাক কারখানাগুলো সচল রাখা হচ্ছিল। আর এ লোকসান থেকে বেরিয়ে আসতে এক এক করে পোশাক কারখানা ইউনিট বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে।

এ বিষয়ে সানম্যান গ্রুপের মুখপাত্র বলেন, নোয়াখালীতে যখন কারখানাগুলো স্থাপন করা হয়, তখন উদ্যোক্তারা জানতেন যে এ ইউনিটগুলোয় উৎপাদন খরচ অনেক বেশি হবে। চট্টগ্রাম থেকে কাঁচামাল এনে পণ্য তৈরি করে তা রফতানি করাসহ পুরো প্রক্রিয়াটি ছিল ব্যয়বহুল। এছাড়া অদক্ষ শ্রমিকের ঝুঁকিও বিবেচনায় নিয়ে কারখানাগুলো চালু করা হয়। কিন্তু পরবর্তীতে দেখা গেল লোকসানের যে অনুমান করা হয়েছিল, তার চেয়ে দুই-তিন গুণ বেশি লোকসান হয়েছে। কিন্তু এলাকার মানুষ উপকৃত হবেন— এমন ভাবনা থেকেই কারখানাগুলো স্থাপন করা হয়।

অনেক বেশি লোকসানের বোঝা বহন করা এখন কঠিন হয়ে পড়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, এ কারণেই এখন অন্য ব্যবসায় সরে যাওয়ার বিষয়টি ভাবা হচ্ছে। বিশেষ করে গ্রামে পোশাক কারখানার স্থলে অন্য কারখানা স্থাপনের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে।

ব্যবসা পরিচালনায় অদক্ষতা ও ব্যর্থতার কারণে চট্টগ্রাম, নোয়াখালী এবং লক্ষ্মীপুরে অবস্থিত পোশাক কারখানাসহ গ্রুপটির আরও কিছু প্রতিষ্ঠান একের পর এক বন্ধ করে দেয় সানম্যান গ্রুপ। আবার গোপনে মালিকানা বদল করা হয় কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের। এছাড়া বিভিন্ন ব্যাংকের পাওনা পরিশোধ অনিয়মিত হয়ে পড়েছে। গ্রুপটির সহযোগী বাংলালায়ন কমিউনিকেশন আইএফআইসিতে, পেনিনসুলা গার্মেন্টস লংকাবাংলা ফাইন্যান্সে ও গোল্ডেন হাইটস লিমিটেড প্রিমিয়ার লিজিংয়ে খেলাপি তালিকায় উঠে আসে। এর মধ্যে বাংলালায়ন কমিউনিকেশন্স লিমিটেডের কাছে আইএফআইসি ব্যাংকের চলতি বছরের ৩১ মার্চ পর্যন্ত সুদাসলে পাওনা হয়েছে ২৪৯ কোটি ৯৬ লাখ টাকা। এ পাওনা আদায়ে ব্যাংকটি নিলামসহ মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে। এছাড়া পেনিনসুলা গার্মেন্টসের কাছে লংকাবাংলা ফাইন্যান্সের পাওনা ছয় কোটি ৯ লাখ টাকা এবং গোল্ডেন হাইটস লিমিটেডের কাছে প্রিমিয়ার লিজিংয়ের পাওনা ১৩ কোটি ৬৬ লাখ টাকা।

প্রিমিয়ার লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স লিমিটেডের আগ্রাবাদ শাখার ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ শাহজামান শেয়ার বিজকে বলেন, সানম্যান গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান গোল্ডেন হাইটস লিমিটেডের কাছে প্রিমিয়ার লিজিংয়ের পাওনা ১৩ কোটি ৬৬ লাখ টাকা। দেড় বছরে তারা একটি কিস্তিও পরিশোধ করেনি। এর আগে ১৫ নভেম্বর ২০১৫ সালে পাওনা আদায়ে ঢাকা সিএমএম কোর্টে মামলা করা হয়। এ মামলায় গ্রেফতার করার ওয়ারেন্টও জারি হয়।

ব্যাংক খাত-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সানম্যান গ্রুপের এক সময় ব্যাংক খাতে ভালো গ্রাহক পরিচিতি থাকলেও এখন নেই। এর মধ্যে এবি, ওয়ান, এক্সিম, ঢাকা, সোনালী, অগ্রণী, জনতা, পূবালী, বাংলাদেশ কমার্স, মার্কেন্টাইল, ইউসিবিএল, ট্রাস্ট, শাহজালাল ইসলামী, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক, উত্তরা ফাইন্যান্স, মাইডাস ফাইন্যান্স, বিআইএফসি, ফারইস্ট ফাইন্যান্স, প্রাইম ফাইন্যান্স, হাজ ফাইন্যান্স, ন্যাশনাল হাউজিং, সিটি ব্যাংক, ফার্স্ট লিজিং, ইসলামি ফাইন্যান্স, ইডকল, সাবিনকো প্রভৃতিতে ঋণ আছে।

টানা এক যুগের সোয়েটার উৎপাদনের ব্যবসা বন্ধ করে এখন মুরগির হ্যাচারি দিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে সানম্যান গ্রুপের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান নোয়াখালী ইসহাকপুর সোয়েটার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড। বিশ্ববাজারে মন্দার কারণে ২০১৬ সাল থেকে পর্যায়ক্রমে এসব প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়া হয়। প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের দাবি, জেলা সদরের মান্নান নগর এলাকার প্রধান কারখানাটিতে এখনো ১০টি অটো মেশিনে উৎপাদন চালু রয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সদর উপজেলার মান্নান নগরে ২০০৩ সালের দিকে কার্যক্রম শুরু করে ইসহাকপুর সোয়েটার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড। ২০০৭ সালে লক্ষ্মীপুর জেলার রামগতিতে ইসহাকপুর সোয়েটার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের অধীন ইউনিট-১ নাম দিয়ে দ্বিতীয় সোয়েটার ফ্যাক্টরি স্থাপন করেন মেজর (অব.) আবদুল মান্নান। ২০০৯ সালে সুবর্ণচর উপজেলায় চালু হয় ইসহাকপুর সোয়েটার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের ইউনিট-২। এ তিন কারখানায় কর্মকর্তা-কর্মচারী মিলিয়ে প্রায় দুই হাজার লোকবল ছিল। বর্তমানে তিনটি কারখানাই বন্ধ।

প্রতিষ্ঠানগুলোর একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কারখানা তিনটিতে বছরে ৩০ কোটি টাকার বেশি সোয়েটার উৎপাদন হতো। প্রতিষ্ঠান তিনটিতে ভূমি, ভবন, মেশিনপত্র মিলিয়ে প্রায় শতকোটি টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছিল। তবে ২০১৬ সালের দিকে শ্রমিক অসন্তোষ, ক্রয়াদেশের সংকট, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, বিশ্ববাজারে চাহিদার মন্দায় কোম্পানি লোকসান গুনতে শুরু করে। ফলে এসব কারখানা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয় কোম্পানি।

তবে কারখানাগুলোয় দীর্ঘদিন কাজ করা একাধিক শ্রমিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, কোম্পানির অভ্যন্তরীণ সমস্যার কারণে এসব প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। বৈশ্বিক বাজারে ধস কিংবা শ্রমিক অসন্তোষ প্রধান কারণ নয়। যদি শ্রমিক কিংবা বাজারের ধস হতো তাহলে টানা এক যুগেরও বেশি সময় ধরে প্রতিষ্ঠান চলত না বা একের পর এক নতুন প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠত না। ২০১৬ সালের দিকে হঠাৎ করে বেতন-ভাতা বন্ধ করে দেয়া হয় শ্রমিকদের। তাও ছয় মাসের বেশি সময় ধরে শ্রমিকরা কোনো আন্দোলনে যাননি। কিন্তু বারবার বেতন দিতে সময়ক্ষেপণ করার কারণে বাধ্য হয়ে তখন শ্রমিকরা আন্দোলনে যান। পরবর্তী সময়ে স্থানীয় প্রশাসন ও রাজনৈতিক নেতাদের হস্তক্ষেপে বেতন-ভাতা দেয়ার শর্তে শ্রমিকরা তখন আন্দোলন থেকে সরে দাঁড়ান। কিন্তু সময় নিয়েও শ্রমিকদের বেতন দিতে গড়িমসি করে কর্তৃপক্ষ। তার পরই মূলত শ্রমিক অসন্তোষ চরম আকার ধারণ করে। এক পর্যায়ে কর্তৃপক্ষ শ্রমিকদের জানায়, কারখানা লোকসানে থাকার কারণে বন্ধ করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কর্তৃপক্ষ।

সানম্যান গ্রুপের এ তিন কারখানার সর্বশেষ অবস্থা নিয়ে খবর নিয়ে জানা গেছে ক্রয়াদেশ সংকট ও বিশ্ববাজারে মন্দার কারণে মূলত কোম্পানি এ তিনটি প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়া হয়। এগুলোতে শতকোটি টাকার বেশি লোকসান দিয়েছে কোম্পানি। তার পরও নানাভাবে এ তিনটি প্রতিষ্ঠানকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু বারবার লোকসান গুনতে গিয়ে অবশেষে বন্ধ হয়ে যায়। তবে এখনো মান্নান নগর এলাকার কারখানাটিতে উৎপাদন অব্যাহত রয়েছে। তিন প্রতিষ্ঠানে সোয়েটার উৎপাদন বন্ধ করা হলেও অন্যভাবে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। এরই মধ্যে মুরগির ডিম ও বাচ্চা উৎপাদন করার বিষয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। বন্ধ হওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোকে হ্যাচারিতে রূপান্তর করার প্রক্রিয়া চলমান।

প্রযুক্তির পরিবর্তনের কারণে এরই মধ্যে সেবা বন্ধ হয়েছে মেজর (অব.) আবদুল মান্নানের গড়ে তোলা ওয়াইম্যাক্স প্রতিষ্ঠান বাংলালায়ন কমিউনিকেশন লিমিটেড। সেলফোন অপারেটরদের থ্রিজি ও ফোরজি সেবা চালুর পাশাপাশি ওয়াইম্যাক্সের প্রযুক্তিগত উন্নয়ন না হওয়ায় বিপাকে পড়ে বাংলালায়ন। এরপর লং টার্ম ইভোল্যুশনের (এলটিই) অনুমোদন দেয়া হলেও তা কাজে লাগাতে পারেনি প্রতিষ্ঠানটি। এরই মধ্যে বিআইএফসি ও সানলাইফ ইন্স্যুরেন্স থেকে বাংলালায়নে বিনিয়োগ ঝুঁকিতে পড়েছে। সাভারে ন্যাশনাল বেভারেজ অ্যান্ড সানম্যান ফুডের কারখানায় সানক্রেস্ট ব্র্যান্ডের কোমল পানীয় উৎপাদনের ব্যবসা শুরু করেছিলেন মেজর (অব.) আবদুল মান্নান। যদিও শেষ পর্যন্ত তার এ ব্যবসাও মুখ থুবড়ে পড়েছে। বহুজাতিক কোমল পানীয় উৎপাদকদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে যেখানে আকিজ ও পারটেক্স গ্রুপ ব্যবসা করে যাচ্ছে, সেখানে বাজার থেকে হারিয়ে গেছে সানক্রেস্ট।

মেজর (অব.) আবদুল মান্নান সবচেয়ে বেশি আলোচনায় এসেছেন ব্যাংক-বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিআইএফসির আর্থিক কেলেঙ্কারির সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার কারণে। ২০১৫ সালে বিআইএফসির ঋণ প্রদানে অনিয়ম ও জালিয়াতির বিষয়টি বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্তেই উঠে আসে। বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশেষ পরিদর্শন প্রতিবেদন অনুসারে, বিআইএফসি থেকে অনিয়ম ও জালজালিয়াতির মাধ্যমে সানম্যান গ্রুপের অনুকূলে ৫১৮ কোটি টাকার ঋণ দেয়ার প্রমাণ পাওয়া যায়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদন্তে আরো উঠে আসে, এসব ঋণের সুবিধাভোগী সানম্যান গ্রুপের চেয়ারম্যান ও বিআইএফসির সাবেক চেয়ারম্যান মেজর (অব.) আবদুল মান্নান।

পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত বিআইএফসি ২০১৭ সালের পর থেকে আর আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করছে না। ২০১৭ সালের আর্থিক প্রতিবেদনে প্রতিষ্ঠানটির ভয়াবহ আর্থিক বিপর্যয়ের বিষয়টি উল্লেখ করে নিরীক্ষক তার মতামতে উল্লেখ করেছেন, বিআইএফসি ধীরে ধীরে দেউলিয়া হওয়ার পথে এগোচ্ছে। আলোচ্য হিসাব বছরে কোম্পানিটির ৭০০ কোটি টাকা কর-পরবর্তী লোকসান হয়েছে। ২০১৭ সালের ডিসেম্বর শেষে সানম্যান গ্রুপের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছে বিএফআইসির ঋণের পরিমাণ ছিল ৬২১ কোটি টাকা, যার পুরোটাই খেলাপি।

বিআইএফসির ঋণ কেলেঙ্কারির মামলায় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ২০১৯ সালে মেজর (অব.) আবদুল মান্নানসহ সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে দুটি মামলা করে। মামলায় বিআইএফসি থেকে প্রতারণার মাধ্যমে দুটি প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ অবমুক্ত করে ৪৩ কোটি ১৫ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ করা হয়। দুদকের অনুসন্ধানে জানা যায়, ক্লিক টু ডিজাইনের নামে জালিয়াতির মাধ্যমে বরাদ্দ অতিরিক্ত টাকার ইস্যুকৃত চেকগুলোর অধিকাংশ অর্থই ক্লিক টু ডিজাইনের পরিবর্তে বিআইএফসির সাবেক চেয়ারম্যান মেজর (অব.) আবদুল মান্নানের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান—সানম্যান ইন্ডাস্ট্রিয়াল করপোরেশন, বাংলালায়ন কমিউনিকেশনস, সানম্যান ফার্মাসিউটিক্যালস ও গোল্ডেন হরাইজনের অনুকূলে সরাসরি গেছে। অনুসন্ধানে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, জালিয়াতির মাধ্যমে উত্তোলিত টাকার মূল সুবিধাভোগী মেজর (অব.) আবদুল মান্নান। তিনি সংশ্লিষ্ট এ অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত।

আজিম গ্রুপ একটি ওয়ান-ম্যান-ব্যান্ড হিসেবে ১৯৭৫ সালে যাত্রা শুরু করেছিল এবং বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটি ২৮ হাজারেরও বেশি কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছে। গার্মেন্টস শিল্পে একটি অগ্রগামী প্রতিষ্ঠান, যেটি ৪.৫ মিলিয়নেরও বেশি মানুষের ওপর কাজ করছে। গার্মেন্ট শিল্পে সফলতা অর্জনের পর স্টিল শিল্পে যাত্রা শুরু করে ।

বাংলাদেশের গার্মেন্ট শিল্পে আজিম গ্রুপ অন্যতম একটি প্রতিষ্ঠান। ইউএসএ, ইউরোপ, দক্ষিণ আমেরিকা, রাশিয়া, জাপান, চীন এবং অস্ট্রেলিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রতিষ্ঠানটি তৈরি পোশাক রফতানি করে আসছে।

বিদেশী বিনিয়োগে প্রতিষ্ঠিত ইয়াংওয়ান এর অবদান, উত্থান, বিকশিত হওয়ার বিশ্লেষণ কেন জরুরী।

১৯৮০ সালে ইয়াংওয়ান নামে অপর একটি কোরিয়ান কর্পোরেশন বাংলাদেশি ট্রেকসীম লিমিটেড নামে অপর একটি কোম্পানির সঙ্গে প্রথম যৌথ উদ্যোগে তৈরি পোশাক কারখানা গড়ে তোলে। বাংলাদেশি অংশীদাররা নতুন প্রতিষ্ঠান ইয়াংওয়ানস বাংলাদেশ-এ শতকরা ৫১ ভাগ ইকুইটির মালিক হয়। এটি প্রথম ১৯৮০ সালের ডিসেম্বর মাসে বাংলাদেশ থেকে প্যাডেড এবং নন-প্যাডেড জ্যাকেট সুইডেনে রপ্তানি করে। উভয় ক্ষেত্রেই বাজারজাতকরণের দায় বিদেশি অংশীদাররাই নিয়েছিল।

১৯৮০ সালে ইয়াংওয়ানের কারখানা যদি বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত না হত, তাহলে হয়ত বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্পের ইতিহাস অন্য কোন ভাবে রচিত হত। আমি নিজে ১৯৯৭ সালে এই কারখানায় কাজ করার সুবাদে পোশাক শিল্পের ভিশনারী উদ্যোক্তা মিঃ কিহাক সাং কে কাছে থেকে দেখার, জানার এবং হাতে কলমে শেখার সুযোগ পেয়েছিলাম।

মিঃ পারফেক্ট বলতে যা বুঝায় তিনি আমার চোখে দেখা প্রথম সেই ব্যক্তি। কি পরিমান এনার্জি লেভেল, যে কোন কথা মনে রাখার অসাধারণ ক্ষমতা, ভবিষ্যৎ দ্রষ্টা এবং অফুরন্ত প্রাণ শক্তি থাকলে একটা মানুষ উন্নতির চরম পর্যায়ে পৌঁছাতে পারে। তা আমি তার কাছে থেকে দেখেছি আর কিছুটা শিখেছি।

১৯৮০ সালে নিজেদের প্রথম কারখানা স্থাপন করেছিল ইয়ংওয়ান। তখন এ খাতের পথিকৃৎ ভাবা হতো প্রতিষ্ঠানটিকে। বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের প্রধান ও সাবেক পররাষ্ট্র সচিব ফারুক সোবহানও গার্মেন্ট খাতের অগ্রগতির পেছনে কৃতিত্ব দিয়েছেন কোম্পানিটিকে। তিনি বলেন, ‘তারা বহুবিদ প্রভাব রেখেছে। তাদের পথ অনুসরণ করে বহু কোরিয়ান কোম্পানি এ দেশে এসেছে। তাদের অভিজ্ঞতার সুবিধাভোগী হয়েছে বহু মানুষ।’ তিনি আরো বলেন, ‘এছাড়া শ্রম ও কারখানার পরিবেশ এবং পেশাদারিত্বের দিক থেকেও খুব উঁচুমান স্থাপন করেছেন কি-হাক সাং। সেখান থেকে শিখে প্রচুর মানুষ অন্যত্র যোগ দিয়েছে বা নিজে কোম্পানি চালু করেছেন।’

বাংলাদেশি বাজারে ইয়ংওয়ানের প্রবেশ ছিল আকস্মিক। তখনকার স্মৃতিচারণ করে সাং বলেন, ‘বাংলাদেশে তাড়াতাড়ি আসার ব্যাপারে আমার দূরদর্শিতা ও সাহসী সিদ্ধান্তের প্রশংসা করেন অনেকে। কিন্তু দূরদর্শিতার দরুন আমরা এখানে আসিনি। আমরা আসলে পরিস্থিতি দেখে প্রলুব্ধ হয়েছিলাম।’

পরিবারের তেমন অর্থসম্পদ ছিল না মিঃ সাং-এর। কোরিয়ার একটি পোশাক রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের বিক্রয়কর্মী হিসেবে সত্তরের দশকের গোড়ার দিকে কাজ শুরু করেন তিনি। ইউরোপিয়ান ক্রেতাদের দেখভাল করা ছিল তার কাজ। এসব যোগাযোগের মধ্য দিয়ে তিনি বয়স্ক দুই স্বদেশির সন্ধান পান। আর তিনজন মিলে প্রতিষ্ঠা করেন ইয়ংওয়ান। মাত্র ২৭ বছর বয়স ছিল তার। বাকি আংশীদারদের চেয়ে কোম্পানিতে তার শেয়ার ছিল কম। পাশাপাশি তাকেই সব কাজ করতে হতো।

এরপর এক পার্টনারের বাংলাদেশি বন্ধু এ দেশে কারখানা স্থাপনে উৎসাহিত করেন তাদের। ভাড়া করা একটি ভবনে ৩০০ শ্রমিক দিয়ে শুরু তাদের পথচলা। এর কিছুদিন পর, প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান এক অভ্যুত্থানে নিহত হন। অস্থির অবস্থায় সাং-এর পার্টনার আর বাংলাদেশে আসতে চাইলেন না। ফলে দায়িত্ব পড়ে যায় তার কাঁধে। ১৯৮৪ সালের দিকে পার্টনারশিপের অবস্থা তথৈবৈচ হয়ে উঠে। ব্যয় কমিয়ে কিছু টাকা ধার করেন মিঃ সাং। আর বাকি পার্টনারদের অংশ কিনে কোম্পানির একক মালিক বনে যান।

চট্টগ্রামে সরকারের প্রতিষ্ঠিত ইপিজেডে চলে যায় ইয়ংওয়ান। সেটি ১৯৮৭ সালের কাহিনী। ১৯৯৩ সালে ঢাকার নতুন ইপিজেডে প্রথম কোম্পানি হিসেবে বিক্রয়কেন্দ্র স্থাপন করে ইয়ংওয়ান। এর আগে ১৯৯১ সালে সাইক্লোনের জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হয়ে যায় চট্টগ্রামের কারখানা। অর্ডার পেয়ে তৈরি করা ৩ লাখ পোশাক কাদাতে ডুবে যায়। পাশাপাশি সামুদ্রিক লবণে নষ্ট হয়ে যায় মেশিন। ঢাকায় পৌঁছতে তিন দিন লেগেছিল সাংয়ের। এবার তিনি নিজের কারখানা স্থাপনের প্রতিজ্ঞা করেন। বহুতল ভবন নির্মাণের পরিকল্পনা নেন তিনি, যাতে করে পোশাক জলসীমার ওপরে সংরক্ষণ করা যায়। সাং বলেন, ‘এটি ছিল ভালো অনুশীলন। কোম্পানির বিপুল ক্ষতি হয়েছিল যদিও। আমরা প্রায় ৪০ লাখ ডলার সমপরিমাণের ক্ষতির শিকার হয়েছিলাম। সময় মতো অর্ডার ডেলিভারি করতে পারিনি।’

এরপর এলো অবরোধ। বেতন বৃদ্ধির সময়সীমা নিয়ে অবরোধ ডাকা হলো। তার বাংলাদেশি কোম্পানি ম্যানেজারকে পিটিয়ে গুরুতর আহত করা হয়। পরে চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুরে নিয়ে যেতে হয় তাকে। কিন্তু এত কিছুর পরও টিকে গেছে ইয়ংওয়ান। খেলাধুলার পোশাক তৈরির দিকে মনোনিবেশ ছিল কোম্পানিটির। নর্থফেস-এর কোরিয়ান লাইসেন্স রয়েছে তাদের। নাইক, অ্যাডিডাস, পাতাগোনিয়া, এল.এল. বিন ও লুলুলেমনের মতো এ খাতের শীর্ষ সব ব্র্যান্ডের পোশাক তৈরি করে সাংয়ের কোম্পানি।

বাংলাদেশে অবস্থান পাকাপোক্ত করে এখানেই কোরিয়ান রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতকরণ অঞ্চল (কেইপিজেড) স্থাপনের পরিকল্পনা হাতে নেন তিনি। এর মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের উৎপাদনকারীদের এক ছাতার নিচে নিয়ে আসার প্রত্যাশা ছিল তার। ১৯৯৯ সালের দিকে চট্টগ্রামে প্রায় ২৪৯৩ একর জমি কিনে প্রতিষ্ঠানটি। এগুলোর বেশিরভাগই ছিল পতিত জমি। তবে ফেরির মাধ্যমে সরকারি ইপিজেড থেকে অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই এখানে আসা যেত। কিন্তু তখনই শুরু হয় রাজনৈতিক অস্থিরতা। সরকার ওই জমি বিক্রি করে বটে। কিন্তু পরিবেশ ছাড়পত্র দিতে ১০ বছর সময় নেয়। সাং বলেন, এর ফলে সম্ভাব্য জায়ান্ট আংশীদার স্যামসাং অপেক্ষা করতে করতে বিরক্ত হয়ে যায়। বাংলাদেশের বদলে তারা ভিয়েতনামে মোবাইল ফোন কারখানা স্থাপন করে। আবার একই সময়ে, অন্যান্য কিছু উদীয়মান অর্থনীতির দেশ কারখানা স্থাপনে স্বাগত জানায় ইয়ংওয়ানকে।

তবে ছাড়পত্র পেতে দেরি হলেও এ সময়ে কেনা জমির সৌন্দর্যবর্ধন করেন সাং। সেখানে প্রায় ১৮ লাখ গাছ লাগানো হয়, তৈরি করা হয় বেশ কয়েকটি লেক। দেশের সবচেয়ে বড় বেসরকারি পানি সংরক্ষণাগারও স্থাপন করে ইয়ংওয়ান। এখন একে আকর্ষণীয় রিসোর্টের মতো মনে হয়। চারপাশে পাহাড় সারি, নির্মল বাতাস, বহু জাতের পাখি একে আরো সৌন্দর্যমণ্ডিত করেছে। আছে গলফ খেলার মাঠ, যেখানে যে কেউ, বিশেষ করে কর্মীরা গলফ খেলতে পারেন। ২০০৯ সালের দিকে প্রয়োজনীয় অনুমোদন পায় ইয়ংওয়ান। সেখানে তৈরি করা হয় চারটি কারখানা। কেইপিজেডের ১৮টি কারখানায় এখন কর্মসংস্থান হয়েছে ১৫ হাজার মানুষের। আগামী পাঁচ বছরে আরো ১০০টি স্থান তৈরি করা হবে। এগুলোর প্রতিটিতে কাজ করবে প্রায় ১ হাজার মানুষ।

ইয়ংওয়ানের একটি কারখানায় ঘুরে এসে দেখা গেল চমকপ্রদ চিত্র। গড়ে ২৫ বছরের কম বয়সী নারীরা বিশেষ আরামদায়ক চেয়ারে সারিবদ্ধভাবে বসে কাজ করছেন। এ চেয়ারগুলো ইতালি থেকে বিশেষভাবে তৈরি করে আনা হয়েছে। কারখানায় হাঁটার সময় বেশ তীক্ষ্ম থাকে মিঃ সাংয়ের দৃষ্টি। নৈপুণ্য ও পরিচ্ছন্নতা নিয়ে সামান্য অনিয়মও বরদাশত করতে চান না তিনি। ত্রুটি দেখলেই তেতে ওঠেন, ভুলেই যান যে পাশে ভিজিটররা আছেন। তৈরি পোশাকের ছোট্ট একটি স্টিকার মাটিতে আটকে থাকতে দেখে অসন্তুষ্ট হন তিনি। ম্যানেজারকে ডেকে তিরস্কার করে বলেন, এরপর এ ধরনের হেলাফেলা হবে পোশাকের বেলায়। কম্পিউটার চালিত মেশিনে শিট কাটছিলেন এক নারী। কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে দেখেন মিঃ সাং। এরপর এক সুপারভাইজরকে ডেকে নির্দেশনা দেন। আক্ষেপ নিয়ে তিনি বলেন, সর্বত্র আমি দেখছি লোকবলের অপচয়। বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্প

কেইপিজেড নিয়ে সরকারের বিলম্বতেও তিনি সমানভাবে বিরক্ত। ট্রান্সফারের চূড়ান্ত অনুমোদন না পেলে অন্যান্য কোম্পানিকে এখানে আনতে পারছেন না তিনি। কিন্তু কেন পরিবেশ ছাড়পত্রের জন্য এত দেরি, তার কোনো উত্তর নেই সাংয়ের কাছে। জমির জন্য ১৭ বছর আগে টাকা পরিশোধ করলেও ছাড়পত্র মিলছে না। অথচ, আইনানুসারে সঙ্গে সঙ্গে অনুমোদন দেয়ার কথা। জানতে চাইলে অসহায় হাসি হাসেন তিনি। বলেন, ‘আমরা এর সঙ্গে লড়াই করছি। বিনিয়োগ বিশ্বে বাংলাদেশের সুনাম হারানো ও কেন বিপুল বিনিয়োগ এ দেশে হচ্ছে না, তার অন্যতম কারণ এটি।’ ঢাকার পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ও আইএমএফের সাবেক অর্থনীতিবিদ আহসান মনসুর একমত হলেন।

তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের জন্য কেইপিজেড ভালো রোল মডেল হতে পারতো। অথচ এ সুযোগ হারাচ্ছে বাংলাদেশ।’ ঢাকায় অনেকে বলছে এক কোম্পানির জন্য ২৪৯২ একর জমি একটু বেশিই হয়ে যায়। মনসুরের পাল্টা বক্তব্য, ‘এ কথা সরকারের জমি বিক্রির আগেই ভাবা উচিত ছিল। যখন জমি দিয়ে দেয়া হয়েছে, সেখান থেকে সরে আসতে পারবেন না আপনি।’ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের কর্মকর্তারা এ প্রশ্নের তাৎক্ষণিক জবাব দিতে পারবেন না বলে জানান।

কিন্তু মিঃ সাং বলছেন, জুলাইয়ের সন্ত্রাসী হামলা গত তিন দশকের সব সমস্যাকে ছাড়িয়ে গেছে। বেশিরভাগ বিদেশি ক্রেতাই এ দেশে আর আসতে চায় না। ইয়ংওয়ানসহ বহুজাতিক কোম্পানিগুলো তাদের বিদেশি কর্মীদের দেশ থেকে অন্যত্র নিয়ে গেছে। সাং বলেন, ‘যখন সাইক্লোন আসে, তখন আপনি জানেন যে পরবর্তী মৌসুমের আগে আর কোনো ঝড় আসবে না। কিংবা আপনি উঁচু ভবন নির্মাণ করতে পারেন। কিন্তু এটা ছিল একেবারে বুকের ওপর হামলা।’

অনেক ক্রেতা জানেন বাংলাদেশের প্রতি কি-হাক সাংয়ের বিশেষ অনুরাগের কথা। তাই কিছুটা ভদ্রভাবে তারা তাকে জিজ্ঞেস করেছেন অন্য দেশগুলোতে থাকা ইয়ংওয়ানের কারখানাগুলোতে উৎপাদন বাড়ানো যায় কিনা। কিন্তু বাংলাদেশের ওপর হাল ছাড়তে রাজি নন সাং। তিনি বলেন, ‘অন্যদের মতো একই নিঃশ্বাস আমিও নিচ্ছি। তাই এখনই আক্রমণাত্মক নীতিতে অন্য দেশে বিস্তারের ইচ্ছা নেই। অবস্থা কী দাঁড়ায় তা দেখতে আগামী কয়েক মাস ভাববো। আমি যে বিনিয়োগ শুরু করেছি, তা শেষ করতে চাই যত দ্রুত সম্ভব। আমি বাংলাদেশের উন্নয়নে অঙ্গীকারবদ্ধ। আমাদের প্রয়োজন আছে দেশটির। বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্প

আজকে কি-হাক সাং সম্পদশালী ব্যক্তি। ইয়ংওয়ান হোল্ডিংসের ১৭ শতাংশ শেয়ারের মালিক তিনি। আরেকটি হোল্ডিং কোম্পানির মাধ্যমে তিনি কমপক্ষে আরো ২৯ শতাংশ শেয়ারও তার। এগুলো একত্রিত করলে তিনি প্রায় ৩৪ কোটি ডলারের মালিক। তার তিন মেয়ে। সবাই এ ব্যবসায় বিভিন্নভাবে জড়িত। মেজ মেয়ে রেইউন সাং হোল্ডিং কোম্পানির প্রধান নির্বাহী।

তবে তার নিজের শৈশব এতটা সচ্ছল ছিল না। বাবা-মায়ের ৬ সন্তানের মধ্যে তিনি ছিলেন দ্বিতীয়। তিনি যখন হামাগুড়ি দিয়ে হাঁটা শিখছেন, তখনই ১৯৫০ সালে কোরিয়ান যুদ্ধ শুরু হয়। রাজধানী সিউল থেকে গ্রামের বাড়ি চ্যাংনিয়ংয়ে পাড়ি জমায় তার পরিবার। তার বাবা তবে এক সময়কার সম্পদশালী এক বংশের সদস্য। কিন্তু ওই বংশের সব সম্পত্তি ১৯৪৭ সালে পুনঃবণ্টিত হয়ে যায়। মৃদু হেসে তিনি বলেন, ‘হয়তো আমি খুবই ধনী জমিদার পরিবারে জন্ম নিয়েছিলাম। কিন্তু শিগগিরই আমরা গরিব হয়ে যাই।’ পরে পড়ালেখার উদ্দেশ্যে সাংকে আবার সিউলে পাঠানো হয়। কলেজে পড়া অবস্থায় সেখানে তাকে একটি বাড়ি কিনে দেন তার বাবা। ৫০ বছর পরও ওই বাড়িতেই বসবাস করেন সাং। পাহাড়ে ঘুরে বেড়াতে ভীষণ পছন্দ তার। ছুটির সপ্তাহান্তে তিনি ছুটে যান গ্রামের বাড়িতে। অদ্ভুত এক শখও আছে। বহু বছর ধরে বিভিন্ন ধরনের ক্যামেরা সংগ্রহ করেছেন। বর্তমানে এই সংগ্রহশালায় প্রায় ৪ হাজার ক্যামেরা আছে! সিউলে তিনি এসব ক্যামেরা প্রদর্শনীর জন্য একটি স্টুডিও বানাচ্ছেন।

৩৬ বছর ধরে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতের সঙ্গে জড়িয়ে আছেন কি-হাক সাং। আজ তিনি এ খাতের সবচেয়ে বড় রপ্তানিকারক। কিন্তু এতদূর উঠে আসতে বহু প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হতে হয়েছে তাকে। নিজের কারখানায় বন্যা ও ধর্মঘটের প্রভাব দেখেছেন। অন্যদের কারখানায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ও প্রত্যক্ষ করেছেন। চাক্ষুস করেছেন রাজনৈতিক অভ্যুত্থান ও হত্যাকাণ্ড এবং ইদানীংকালের বিদেশিদের টার্গেট করে চালানো সন্ত্রাসী হামলা। কোরিয়ান কোম্পানি ইয়ংওয়ানের চেয়ারম্যান হিসেবে এ দেশের অনেক দুর্দশার সাক্ষী তিনি। এছাড়া এখন আটকে আছেন আমলাতন্ত্রের জটে। এতসব সত্ত্বেও তিনি এ দেশকে নিয়ে এখনও আশাবাদী। ‘আমি বাংলাদেশের সঙ্গে বেড়ে উঠেছি। এটা আমার সংস্কৃতি।’

চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলায় কোরিয়ান রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতকরণ অঞ্চলে (কেইপিজেড) ৪০ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতা সম্পন্ন দেশের একক বৃহত্তম রুফ-টপ সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্প চালু হয়েছে। প্রথম পর্যায়ে এই প্রকল্প থেকে ১৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে। এখান থেকে কেইপিজেডের নিজস্ব চাহিদা মিটিয়ে উদ্বৃত্ত বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করা হবে। এই প্রকল্প থেকে ২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে বলে কেইপিজেড কর্তৃপক্ষ আশা করছে।

কম উৎপাদন খরচের কারণেই বাংলাদেশ বিদেশি ক্রেতার কাছে ক্রমবর্ধমান আকর্ষণীয় ব্যবসা কেন্দ্র হিসেবে পরিচিতি পায়।

কম খরচের সুযোগ গ্রহণ করতেই তারা বিশেষ ব্যবস্থাপনায় কোনো কোনো ক্ষেত্রে সরবরাহকারী ঋণ সহায়তা বৃদ্ধি করে। আবার অনেক ক্ষেত্রে স্থানীয় ব্যাংক ইকুইটি ক্যাপিটালের যোগান দেয়। এত কিছু সত্ত্বেও নতুন কারখানাসমূহ চলতি পুঁজির জন্য প্রচন্ড সমস্যায় পড়ে। এই সময় ব্যাক-টু-ব্যাক এল.সি (লেটার অব ক্রেডিট বা আস্থাপত্র) লেনদেনের জন্য উদ্ভাবিত নতুন পন্থার অবদানে তৈরি পোশাক শিল্পের জন্য আশীর্বাদ বয়ে আনে।ব্যাক-টু-ব্যাক এল.সি চলতি মূলধনের সমস্যা লাঘব করে তৈরি পোশাক শিল্পের জন্য মানসম্পন্ন কাপড় আমদানির সুযোগ সৃষ্টি করেছে।

১৯৮২ সালে কারখানার সংখ্যা ছিল ৪৭ এবং ১৯৮৫ সালে ৫৮৭, আর ১৯৯৯ সালে ২,৯০০টিতে উন্নীত হওয়ার মধ্য দিয়ে এই শিল্পের সাফল্য স্পষ্ট হয়ে উঠে। এই ধারাবাহিকতায় উৎপাদন ও রপ্তানি ক্ষমতা সমানতালে বৃদ্ধি পেয়ে ২০০৯ সালে কারখানার সংখ্যা ৩ হাজারে উপনীত হয়। বাংলাদেশে ইতোমধ্যে বিশ্বের দ্বাদশ বৃহত্তম পোশাক রপ্তানিকারক দেশে পরিণত হয়েছে। তন্মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের স্থান ষষ্ঠ এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাজারে টি-শার্ট রপ্তানিতে বাংলাদেশ পঞ্চম স্থান দখল করে আছে। ১৯৯০-এর দশকে এ শিল্পখাতের সম্প্রসারণ ঘটেছে বার্ষিক প্রায় ২২ শতাংশ হারে।

১৯৮৩-৮৪ সালে তৈরি পোশাক রপ্তানি থেকে আয় হয় মাত্র ০.৯ বিলিয়ন ডলার, যা ছিল বাংলাদেশের মোট রপ্তানি আয়ের শতকরা ৩.৮৯ ভাগ। ১৯৯৮-৯৯ সালে তৈরি পোশাক রপ্তানি থেকে আয় ছিল ৫.৫১ বিলিয়ন ডলার যা মোট রপ্তানি আয়ের শতকরা ৭৫.৬৭ ভাগ। তবে নিট বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন ছিল এর মাত্র ৩০% কারণ, তৈরি পোশাক শিল্পের কাঁচামাল এবং আনুষঙ্গিক উপকরণ আমদানিতে ব্যয় হয় আয়কৃত বৈদেশিক মুদ্রার প্রায় ৭০%।

১৯৮৪ সালে এসে একটু অতীতের আলোচনায় ফিরে যেতে চাইছি। আমাদের পোশাক শিল্পের উত্থান, পরিপূর্ন অবয়ব প্রদান এবং বৃহৎ ইন্ডাস্ট্রিতে রূপান্তরিত করণের মূল আর্কিটেক কিংবা ভিশনারী নেতৃত্বের গুণাবলী যে কর্মবীরের মাঝে আমরা খুঁজে পেয়েছিলাম তিনি হলেন ওপেক্স গ্ৰুপের চেয়ারম্যান জনাব আনিসুর রহমান সিনহা।

আনিসুর রহমান সিনহা এবং ওপেক্স গ্ৰুপ এর উত্থান, বিকাশ সংকোচন।

দেশের তৈরি পোশাক খাতের অন্যতম পথিকৃৎ উদ্যোক্তা আনিসুর রহমান সিনহা। ১৯৮৪ সালে ওপেক্স গ্রুপের মাধ্যমে পোশাক কারখানা গড়ে তোলেন তিনি। পাশাপাশি সিনহা টেক্সটাইল গ্রুপের মাধ্যমে স্থাপন করেন পোশাক খাতের ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ শিল্পও। ঢাকা থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে কাঁচপুরে ৪৩ একর জমির ওপর গড়ে ওঠা তার এ শিল্প উদ্যোগ বস্ত্র ও পোশাক খাতে এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ উৎপাদন ক্ষেত্র।

দেশের তৈরি পোশাক খাতের অন্যতম পথিকৃৎ উদ্যোক্তা আনিসুর রহমান সিনহা। ১৯৮৪ সালে ওপেক্স গ্রুপের মাধ্যমে পোশাক কারখানা গড়ে তোলেন তিনি।

শিল্প সংশ্লিষ্টদের পর্যালোচনা বলছে, দেশ গার্মেন্টস লিমিটেড ছিল তখনকার বিবেচনায় প্রথম আন্তর্জাতিক মানের রফতানিমুখী পোশাক কারখানা। তবে শিক্ষা, আবাসন ব্যবস্থাসহ সার্বিক দিক বিবেচনায় বৃহৎ আকারের প্রথম কারখানাটি গড়ে তোলেন অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা আনিসুর রহমান সিনহা। এক পর্যায়ে এশিয়ার বৃহত্তম বস্ত্র ও পোশাক শিল্প অবকাঠামো হিসেবেও স্বীকৃতি পায় তার কারখানাটি। নব্বই দশকের শেষ দিকে বিজিএমইএর সভাপতি হিসেবে পোশাক খাতের নেতৃত্বও দেন তিনি।

বিশাল এ শিল্প গ্রুপের মাধ্যমে অল্প সময়ের মধ্যেই পশ্চিমা ক্রেতাদের নজর কেড়েছিলেন আনিসুর রহমান সিনহা। ওই সময় পোশাকের কার্যাদেশ দিতে দিনের পর দিন তার সাক্ষাৎ লাভের অপেক্ষায় থাকতেন ক্রেতারা। সাক্ষাতের জন্য সময় না পেলে অনেকে তার বিদেশযাত্রার সময়সূচি সংগ্রহ করতেন। লক্ষ্য থাকত, বিমানে একান্তে পেলে ক্রয়াদেশের বিষয়ে কথা বলা। কিন্তু সবই এখন রূপকথা। একসময় ওপেক্স-সিনহা গ্রুপের সাব-কন্ট্রাক্ট বা ঠিকার কাজ করে অনেক শিল্পোদ্যোক্তা তৈরি হলেও এখন নিজেই ধুঁকছে পথিকৃৎ এ প্রতিষ্ঠান। পোশাক শিল্পের সেই বাতিঘর এখন প্রায় নিবুনিবু বলে জানিয়েছেন শিল্পসংশ্লিষ্টরা। 

বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্প

খাতসংশ্লিষ্টদের বলা কথার সত্যতা পাওয়া গেছে সরকারি সংস্থার দেয়া তথ্যেও। শ্রম মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, কাঁচপুরে ওপেক্স অ্যান্ড সিনহা টেক্সটাইল গ্রুপের ম্যানুফ্যাকচারিং কমপ্লেক্সে বর্তমানে কেবল নয়টি ইউনিট সচল আছে। একসময় ওই গ্রুপের কাঁচপুরের ইউনিটগুলোতে ৪৫ হাজারেরও বেশি কর্মী কাজ করলেও বর্তমানে এ সংখ্যা ১৩ থেকে ১৪ হাজারে নেমে এসেছে। কেবল তা নয়, গত তিন বছরের নানা সময়ে শ্রম অসন্তোষের মুখে পড়তে হয়েছে গ্রুপটিকে। ছাঁটাই হয়েছেন অনেক পুরনো কর্মী। নিয়মিত কর্মীদের বেতন বকেয়া পড়ার অভিযোগও উঠেছে একাধিকবার। অতিসম্প্রতি কারখানা লে-অফের ঘটনা ঘটেছে। কভিড-১৯ পরিস্থিতিতে লে-অফ থাকা কারখানার লে-অফের মেয়াদ বেড়েছে।

ওপেক্স অ্যান্ড সিনহা টেক্সটাইল গ্রুপের চেয়ারম্যান আনিসুর রহমান বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে বলেন, বিনিয়োগটা অনেক বেশি করে ফেলেছিলাম। তাতে অবকাঠামোটা খুব শক্তপোক্ত হলেও বর্তমান পরিস্থিতিতে সবার মতো আমাদেরও ব্যবসা খারাপ যাচ্ছে। অর্থকড়ি খরচ করা নিয়ে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন এসেছে জানিয়ে তিনি বলেন, আগে ভালো পোশাক পরিধানের কালচার ছিল, সেই কালচার এখন পরিবর্তন হচ্ছে। এখন প্রযুক্তি পণ্যে বিশেষ করে ইলেকট্রনিকস পণ্যে মানুষের ব্যয়ের অভ্যাস বেড়েছে। অর্থাৎ পোশাক কেনাকাটায় ব্যয় অনেক কমিয়েছে মানুষ। তার পরও আমাদের ভয় পাওয়ার কিছু ছিল না। বাংলাদেশের পোশাক শিল্প আগের অবস্থায় ফিরে আসতে পারত, যদি কভিড এসে ধাক্কা না দিত। করোনা এসে অনেক কিছুকেই অনিশ্চিত করে তুলেছে। অর্থনীতিতে মারাত্মক প্রভাব পড়েছে। এই সময়টায় আমাদের টিকে থাকতে হবে।

কারখানা লে-অফের প্রসঙ্গে আনিসুর রহমান সিনহা বলেন, সবটা না, অল্প কিছু লোক লে-অফের মধ্যে পড়েছে। দশটা লাইন থাকলে দুটি লাইনে যদি কাজ কম হয় তখনই লে-অফ করা হয়।

খাতসংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, কয়েক বছর ধরে ওপেক্স অ্যান্ড সিনহা টেক্সটাইল গ্রুপের কারখানায় প্রায়ই সমস্যা দেখা দিচ্ছিল। যৌক্তিক-অযৌক্তিক নানা দাবিদাওয়া নিয়ে কর্মীরা চাপ দিতেন কর্তৃপক্ষকে। আইনে উল্লেখ না থাকলেও বিভিন্ন সুবিধা দিতে বাধ্য হতেন আনিসুর রহমান সিনহা। এতে তার প্রতিষ্ঠানের আর্থিক পরিস্থিতি আরো খারাপ হয়েছে। এখন আর এত বড় উৎপাদন সক্ষমতা পূর্ণ সচল রাখাও সম্ভব হচ্ছে না। আনিসুর রহমান সিনহার জন্য সাম্রাজ্য এখন বোঝায় পরিণত হয়েছে। এ বোঝা বহন করা তার পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। কাজের নেশায় তিনি একের পর এক সম্প্রসারণ প্রকল্প হাতে নিয়েছিলেন। কিন্তু এখন সেগুলোই তার হতাশার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কোনোভাবেই বোঝামুক্ত হওয়ার পথ খুঁজে পাচ্ছেন না তিনি। আবার পিছুটানও কাজ করছে তার।

এ কারণে যুক্তরাজ্যে অবস্থান করা একমাত্র সন্তানের কাছে চলে যাওয়ার পরিকল্পনাও বাস্তবায়ন পিছিয়ে দিচ্ছেন বারবার।

দেশের গণ্ডি পেরিয়ে ব্যবসায়িক কার্যালয় খুলেছিলেন আনিসুর রহমান সিনহা। যুক্তরাজ্য, হংকং, চীন, জার্মানি ও যুক্তরাষ্ট্রেও আছে ওপেক্স অ্যান্ড সিনহা টেক্সটাইলের কার্যালয়। যুক্তরাজ্যে আছে ওপেক্স ফ্যাশন লিমিটেড নামের লিয়াজোঁ অফিস। ২০১০ সালের মে মাসে প্রতিষ্ঠানটি চালু হয়। বিশ্বের সব নামকরা বড় ক্রেতার কাজগুলোর সমন্বয় ও সম্প্রসারণের লক্ষ্যেই অফিসটি চালু করেছিলেন তিনি। সেখানে প্রধান নির্বাহীর দায়িত্বে রয়েছেন তার একমাত্র সন্তান তানজিয়া সিনহা। বাংলাদেশসহ চীন ও ভারতের ১৪০টিরও বেশি কারখানাকে ওপেক্স ফ্যাশন ইউকের উৎপাদন ক্ষেত্র হিসেবে ব্যবহার হয় বলে দাবি ওপেক্স ফ্যাশন ইউকের।

অনেক বড় উৎপাদন সক্ষমতা ওপেক্স অ্যান্ড সিনহা গ্রুপের জন্য বড় সমস্যার কারণ হয়েছে বলে আমরা সকলেই জানি। কাঁচপুরে ওপেক্স অ্যান্ড সিনহা টেক্সটাইল গ্রুপের ইউনিটগুলোর পূর্ণ সক্ষমতা ব্যবহার করতে হলে মাসে ন্যূনতম ১ থেকে দেড় কোটি পিস পোশাক তৈরির কাজ থাকতে হবে। তবে এই বড় বিনিয়োগ কোনো সমস্যা হতো না যদি কাজ থাকত।

বিভিন্ন সাক্ষাৎকার ও পত্র পত্রিকায় পরে যতটুকু জেনেছি ওপেক্স অ্যান্ড সিনহা টেক্সটাইল গ্রুপে অনেক সমস্যা আগে থেকেই চলে আসছিলো। গ্রূপ বড় হয়ে যাওয়ায় অনেক কিছুই ঠিকভাবে ম্যানেজ করে চলা সম্ভব পর হচ্ছিলনা। দিনে দিনে সমস্যা বাড়তেই থাকে এবং সমস্যা গুলো প্রকট আকার ধারণ করে রানা প্লাজা ধস পরবর্তী প্রেক্ষাপটে। কারখানা মূল্যায়নে নিয়োজিত জোট অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্স অযাচিতভাবে সিনহার কারখানা ইউনিটগুলোর ভবন ত্রুটি নিয়ে পরিস্থিতি আরো ঘোলাটে করে দেয়। আগে অনেক বড় ক্রেতা ওপেক্স অ্যান্ড সিনহায় কাজ দিত। অ্যাকর্ড-অ্যালায়েন্সের তাণ্ডবে তারা মুখ ফিরিয়ে নিতে শুরু করে। বিপুল পরিমাণ ক্রয়াদেশ বাতিলের পাশাপাশি অনেক পণ্য মজুদ পড়ে থাকে তার কারখানায়।

বর্তমানে আনিসুর রহমান সিনহার ব্যবসা আরো কঠিন করে তুলেছে ঋণের দায়। রানা প্লাজা ধসের আগে বড় আকারের ব্যাংকঋণ ছিল না। কিন্তু রানা প্লাজা ধস পরবর্তী সময়ে ব্যাংক দেনা বেড়েছে তার। এখনও রফতানি আদেশ নেয়ার সক্ষমতা থাকলেও ব্যাংকের সহযোগিতা ছাড়া তা সম্ভব হচ্ছে না। এ অবস্থায় শ্রেণীকরণকৃত ঋণগুলো পুনর্গঠনের চেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন এ ব্যবসায়ী।

কাঁচপুরে গ্রুপের বেশির ভাগ কারখানাই এখন লে-অফ ঘোষিত অবস্থায় আছে। তবে মিরপুর ও আশুলিয়ায় কারখানা চালু আছে। বন্ধ থাকা কারখানা চালু করতে চাচ্ছে মালিকপক্ষ। কিন্তু আর্থিক সংকটে তা সম্ভব হচ্ছে না। ন্যাশনাল ব্যাংকসহ আরো বেশকিছু ব্যাংকের বিপুল অংকের দেনা রয়েছে গ্রুপের। বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্প

ব্যাংক এশিয়ায় আনিসুর রহমান সিনহার পরিচালক-স্বত্ব ছিল তিনটি। আর্থিক সংকট কাটিয়ে উঠতে এর একটি বিক্রি করে দিয়েছেন ৬০ কোটি টাকায়। পোশাক খাতেরই আরেক বড় গ্রুপের কর্ণধার তা কিনে নিয়েছেন। ইস্টার্ন ব্যাংকেও ওপেক্স অ্যান্ড সিনহা টেক্সটাইল গ্রুপের দায় ছিল। এখন দিন দিন আর্থিক অবস্থা খারাপ হওয়ার কারণে ইবিএল কর্তৃপক্ষ অন্য ব্যাংকে দায় হস্তান্তর করেছে।

আনিসুর রহমান সিনহা তার হাতে গড়া গ্রুপটি বিক্রির উদ্যোগও একাধিকবার নিয়েছেন। ভারতের রিলায়েন্সসহ আরো কিছু কোম্পানি তা ক্রয়ের জন্য সম্ভাব্যতা যাচাইও করেছে। কিন্তু দেনাসহ অনেক বড় হয়ে যায় বিনিয়োগের পরিমাণ। আর আনিসুর রহমান সাহেবও কম দামে ছাড়তে চাচ্ছেন না। এ কারণে এত বড় প্রকল্পের ক্রেতা চেষ্টা করেও খুঁজে পাওয়া যায়নি।

পত্র পত্রিকায় যতদূর পড়েছি, এ ধরনের একজন উদ্যোক্তাকে ভুঁইফোড় শ্রমিক সংগঠন ও নেতাদের তরফ থেকে অনেক অন্যায্য দাবি মানতে হয়েছে। তারা ধীরে ধীরে ওনাকে উৎপাদন থেকে দূরে সরে যেতে বাধ্য করছেন। শিল্পোদ্যোক্তা হিসেবে আনিসুর রহমান সিনহার ভুলও ছিল। কারখানা পরিচালনায় যে লোকবল তিনি নিয়োগ করেছেন তাদের অব্যবস্থাপনাও বর্তমান দুর্দশার অন্যতম বড় কারণ।

এ তিনজনসহ আরো অনেকের প্রয়াসে এগিয়ে যায় দেশের তৈরি পোশাক খাত। এক্ষেত্রে ঢাকার প্রয়াত মেয়র এবং মোহাম্মদী গ্রুপের উদ্যোক্তা আনিসুল হক, হা-মীম গ্রুপের একে আজাদ, ড্রাগন সোয়েটারের উদ্যোক্তা গোলাম কুদ্দুস প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। নব্বইয়ের দশকে আনিসুর রহমান সিনহা যেমন ছিলেন, তেমনি ছিলেন গোলাম কুদ্দুস। শিশুশ্রম মোকাবেলায় বড় ভূমিকা ছিল গোলাম কুদ্দুসের। আর আন্তর্জাতিক বাজারে শুল্ক সুবিধা নিশ্চিতের ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছিলেন আনিসুর রহমান সিনহা।

চলতি শতকের শুরুর দশকে পোশাক খাতকে এগিয়ে নিতে যারা ভূমিকা রেখেছেন, তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য নাম হলো আনিসুল হক। বিশ্বায়নের প্রেক্ষাপটে পোশাক খাতের অস্তিত্ব টিকে থাকবে। শিল্পসংশ্লিষ্ট নীতিনির্ধারকদের এমন বিশ্বাস তৈরি করতে তাকে রীতিমতো যুদ্ধ করতে হয়েছে।

আশির দশকে পোশাক শিল্পকে যারা এগিয়ে নিয়েছেন, তাদের মধ্যে আরো কয়েকজনের নাম স্মরণীয়। নিটওয়্যার কারখানার বিকাশে তারা ভূমিকা রেখেছিলেন। দেশে নিটওয়্যার উদ্যোক্তাদের যাত্রা আশির দশকের শেষের দিকে। এর ধারাবাহিকতায় নব্বইয়ের দশকে যেসব কারখানা ভূমিকা রেখেছে সেগুলোর মধ্যে নেতৃত্বে ছিল এনআর নিটিং মিলস, মিনার টেক্সটাইল, মনোয়ারা টেক্সটাইল, শান নিটিং ইত্যাদি। রফতানিমুখী ওই শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর উত্তরণ ঘটেছিল হোসিয়ারি শিল্প থেকে।

তবে বিশ্বের সাম্প্রতিক আর্থিক মন্দার কারণে যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউ’র বাজারে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয়েছে। এ দুটি বাজারে ভোক্তার ব্যয় হ্রাস পেয়েছে, ফলে বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের চাহিদাও হ্রাস পেয়েছে। ২০০৮ সালে রপ্তানিতে উর্ধ্বগতির পর ২০০৯ সালে প্রবৃদ্ধি ঋণাত্মক হয়েছে। তবে বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের দূরদর্শিতায় ২০১০ সালের শুরুতে আবার মন্দাভাব কাটিয়ে প্রবৃদ্ধির দিকে পা বাড়িয়েছে। এতে প্রতীয়মান হয় যে, বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্প আর্থিক মন্দার ঋণাত্মক প্রভাব কাটিয়ে ওঠার সক্ষমতা অর্জন করেছে।

১৯৮৫ সাল নাগাদ বাংলাদেশ শক্তিমান পোশাক সরবরাহকারী হিসেবে আবির্ভূত হয় এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও ইউরোপের বাজারের ঐতিহ্যবাহী সরবরাহকারীদের কাছে শক্তিশালী প্রতিযোগী হিসেবে পরিণত হয়। ১৯৮৬ সাল থাকে বাংলাদেশ ইউএসএ এবং কানাডার ক্রমবর্ধমান কোটা বাধ্যবাধকতার আওতাভুক্ত হয়। ১৯৮০-র দশকে বেশকিছু দেশে তৈরি পোশাক শিল্প বিপত্তিকর অবস্থায় পড়ে। অভ্যন্তরীণ সমস্যার কারণে শ্রীলঙ্কা এবং দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য কয়েকটি দেশে উৎপাদন খরচ দ্রুত বেড়ে যায়। ক্রেতারা বিকল্প উৎস খুঁজতে থাকে এবং সস্তা শ্রমিক ও বড় আকারের রপ্তানি কোটার সুবাদে বাংলাদেশ একটি আদর্শ বিকল্প হিসেবে প্রতীয়মান হয়। ইউরোপীয় ইউনিয়ন বাংলাদেশকে অব্যাহতভাবে কোটামুক্ত মর্যাদা এবং জিএসপি সুযোগ-সুবিধা দিতে থাকে। তাছাড়া, ইউএসএ এবং কানাডা বাংলাদেশের জন্য বেশ বড় আকারের কোটা বহাল রাখে। এসব সুযোগ গ্রহণ করে বাংলাদেশ পোশাক রপ্তানিতে ইউএসএ, কানাডা এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাজার নিশ্চিত করে। তৈরি পোশাক শিল্প বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে অভ্যন্তরীণ উপাদানগুলি কার্যকর ভূমিকা রাখে এবং প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সস্তা শ্রমিকের সহজলভ্যতা বাংলাদেশকে তুলনামূলক সুবিধা এনে দেয়। সরকারের নীতিসমূহ এই শিল্পখাতের দ্রুত সমৃদ্ধির ক্ষেত্রে অবদান রাখে। সরকার পিঠাপিঠি প্রত্যয়পত্রের মাধ্যমে শুল্কমুক্ত কাপড় আমদানি, শুল্কাধীন গুদাম ব্যবহারের সুবিধাদি, সুদের হারে বিশেষ ছাড়, রপ্তানির জন্য নগদ অর্থে প্রণোদনা, রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতকরণ এলাকার সুবিধাদিসহ বিভিন্ন ধরনের উৎসাহ-উদ্দীপনা যুগিয়ে থাকে। এছাড়া সরকার আমদানি ও রপ্তানি ক্ষেত্রে কার্যকর কিছু আনুষ্ঠানিক পদক্ষেপও গ্রহণ করে।

পোশাক শিল্প তৈরি পোশাক শিল্পের বিস্ময়কর প্রবৃদ্ধির জন্য অভ্যন্তরীণ এবং বাহ্যিক উভয় উপাদানই ভূমিকা রেখেছে। বাহ্যিক কারণের একটি ছিল গ্যাট (GATT) অনুমোদিত ‘মাল্টি ফাইবার অ্যারেঞ্জমেন্ট’ (এমএফএ)-এর অধীনে কোটা পদ্ধতি। এই কোটা পদ্ধতিতে তৈরি পোশাকের আন্তর্জাতিক আউট সোর্সিং পুনর্বিন্যাসের মাধ্যমে বেশি দামে প্রস্ত্ততকারী দেশ থেকে কম দামে প্রস্ত্ততকারী দেশে স্থানান্তর করা হতো। এমএফএ’র প্রয়োগ বাংলাদেশের জন্য অনেকটা আশির্বাদ বয়ে আনে। নিম্ন আয়ের দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত দেশ হিসেবে গণ্য করা হয়। বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে পোশাকের একটি উল্লেখযোগ্য ‘কোটা’ রপ্তানির সুযোগ পায়। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের কোটামুক্ত বাজারের পাশাপাশি বাংলাদেশকে জিএসপি সুযোগ দেয়া হয়। বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে বৃহৎ সরবরাহকারী পোশাক প্রস্ত্ততকারীরা কোটা সুবিধা এবং সস্তা শ্রমের দেশে কারখানা পুনঃস্থাপনের কৌশল গ্রহণ করে। বাংলাদেশকে তারা সম্ভাবনাময় দেশ হিসেবে চিহ্নিত করে। এ কারণেই বাংলাদেশে তৈরি পোশাকের কারখানা গড়ে ওঠে।

১৯৮৭ সাল বাংলাদেশের পোশাক শিল্পে আর এক দিগ্বিজয়ী নাম “নোমান গ্ৰুপ” যুক্ত হয়। বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের জয় যাত্রায় নোমান গ্ৰুপ এবং জনাব নুরুল ইসলাম এর অবদান, উত্থান, বিকাশ হওয়ার বিশ্লেষণ কেন জরুরী।

ইসলামপুরে দোকানে দোকানে গিয়ে একসময় পণ্য বিক্রি করতেন তিনি। পরিবারের আর্থিক অনটন তাঁকে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় আসতে বাধ্য করে। ভাগ্য বদলের আশায় মাত্র ৬৭ টাকা পকেটে নিয়ে ১৯৬৮ সালে ঢাকার পথে পা বাড়ান মোহাম্মদ নুরুল ইসলাম। ওঠেন রাজধানীর খিলগাঁওয়ের একটি মেসে, মাসিক ভাড়া ১৫ টাকা। ঢাকায় এসে শুরু করেন কমিশনের বিনিময়ে পণ্য বিক্রি। সারা দিন বিক্রির পর সন্ধ্যায় টাকা তুলে তারপর গভীর রাতে ফিরতেন মেসে। কয়েক ঘণ্টা ঘুমিয়ে সকাল থেকে আবারও ছুটতেন দোকানে দোকানে পণ্য নিয়ে। পণ্য বিক্রি করে মাসে কমিশন পেতেন ৫ হাজার থেকে ১০ হাজার টাকা।

সেই নুরুল ইসলাম সময়ের ব্যবধানে হয়ে উঠলেন সফল উদ্যোক্তা। দেশের শীর্ষস্থানীয় রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান নোমান গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা তিনি। কিছুদিন আগেও ছিলেন এই গ্রুপের চেয়ারম্যান। মেসের জীবন থেকে এখন তিনি রাজধানীর অভিজাত এলাকা গুলশানের বাসিন্দা। বর্তমানে বড় ছেলের হাতে প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্বের ভার তুলে দিয়েছেন। ছেলের হাতে ব্যবসার ভার তুলে দিলেও নিজে একেবারে উপদেষ্টা হিসেবে পেছন থেকে কোম্পানির নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছেন।

বিক্রয়কর্মী থেকে সফল উদ্যোক্তা

গল্পে গল্পে নুরুল ইসলাম শোনালেন একজন বিক্রয়কর্মী থেকে দেশসেরা উদ্যোক্তা হওয়ার পেছনের কথা। বললেন, ২০১৮ সালে গ্রুপের বার্ষিক বিক্রির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১০০ কোটি ডলার। প্রতি ডলারের বিনিময় মূল্য সাড়ে ৮৪ টাকার হিসাবে বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ প্রায় সাড়ে ৮ হাজার কোটি টাকা। রপ্তানির পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানটি স্থানীয় বাজারেও পণ্য বিক্রি করে থাকে। মূলত স্থানীয় বাজারে পণ্য বিক্রি দিয়েই যাত্রা শুরু হয়েছিল। তাই কোম্পানি বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রপ্তানি বাজার বিস্তৃত হলেও স্থানীয় বাজার থেকে এখনো নিজেদের গুটিয়ে নেননি এই উদ্যোক্তা।

নুরুল ইসলাম জানান, ১৯৬৮ সালে ঢাকায় এসে তৈয়ব আশরাফ টেক্সটাইল মিলস নামের একটি প্রতিষ্ঠানের বিক্রয়কর্মী হিসেবে কাজ শুরু করেন। এ প্রতিষ্ঠানের অধীনে আবার একাধিক প্রতিষ্ঠান ছিল। সেগুলোর মধ্যে অন্যতম মরিয়ম টেক্সটাইল, আরটেক্স ফ্যাব্রিকস, নাজনীন ফ্যাব্রিকস। এসব প্রতিষ্ঠানে উৎপাদিত ক্যারোলিন গেঞ্জি, মশারি, ওড়না এবং পলিয়েস্টার কাপড় ইত্যাদি পণ্য বিক্রি করতেন নুরুল ইসলাম। প্রতিষ্ঠানগুলোর পণ্য বিক্রির পাশাপাশি এসব প্রতিষ্ঠান থেকে নিজের পছন্দে পণ্য তৈরি করে তা–ও বিক্রি করতেন তিনি। কমিশন আয়ের পাশাপাশি নিজের উদ্যোগে পণ্য তৈরি করে তা বিক্রির মাধ্যমে একটু একটু করে মূলধন বাড়াতে থাকেন নুরুল ইসলাম।

এর মধ্যে স্বাধীনতাযুদ্ধ শুরু হলে ফিরে যান চট্টগ্রামের লোহাগাড়ায় নিজ গ্রামে। ওই বছর বিয়েও করেন। যুদ্ধ শেষে আবার ফিরে আসেন কর্মস্থলে। নতুন করে শুরু করেন সবকিছু। এর মধ্যে ব্যাংকঋণের কারণে মরিয়ম টেক্সটাইল, আরটেক্স ও নাজনীন ফ্যাব্রিকসের আর্থিক অবস্থা ক্রমেই দুর্বল হতে থাকে। তখন এসব প্রতিষ্ঠান ভাড়ায় নেন নুরুল ইসলাম। শুরুতে মশারি ও গেঞ্জির কাপড় তৈরি করতেন। ১৯৭৬ সালে পাওনা ঋণ আদায়ে এসব কারখানা একে একে নিলামে তোলে ব্যাংক। নিলামে অংশ নিয়ে যন্ত্রপাতিসহ কারখানাগুলো কিনে নেন নুরুল ইসলাম।

১৯৭৬ সালে প্রথম আরটেক্স ফ্যাব্রিকসের চারটি মেশিন কিনে নেন তিনি। এ জন্য বিনিয়োগ করেন ৮ লাখ টাকা। সেখানে তখন ২২ শ্রমিক কর্মরত ছিলেন। এরপর একে একে কেনেন মরিয়ম টেক্সটাইল, নাজরীন ফ্যাব্রিকসের যন্ত্রপাতি। এ তিন প্রতিষ্ঠানের মোট ১২টি যন্ত্র (মেশিন) নিয়ে শুরু হয় উদ্যোক্তা হিসেবে নুরুল ইসলামের যাত্রা। মাত্র ২২ জন শ্রমিক নিয়ে ১৯৭৬ সালে শিল্পোদ্যোক্তা হিসেবে নুরুল ইসলামের পথচলা শুরু। বর্তমানে তাঁর গড়ে তোলা নোমান গ্রুপের কর্মীর সংখ্যা ৬৫ হাজারের বেশি।

নোমান গ্রুপের যাত্রা

শুরুটা হয়েছিল আরটেক্স ফ্যাব্রিকস, মরিয়ম টেক্সটাইল দিয়ে। ওই নামেই প্রতিষ্ঠানগুলো এখনো টিকে আছে নোমান গ্রুপের অধীনে। ১৯৮৭ সালে এসে বড় ছেলে এ এস এম রফিকুল ইসলাম নোমানের নামে প্রতিষ্ঠা করেন নোমান গ্রুপ। বর্তমানে এ গ্রুপের অধীনে রয়েছে ৩২টি কারখানা ভিন্ন ভিন্ন নামে। এগুলোর মধ্যে স্ত্রী, কন্যা, পুত্র, নাতি-নাতনিদের নামেও রয়েছে একাধিক প্রতিষ্ঠান।

নুরুল ইসলাম জানান, ১৯৭৬ সালে বড় ছেলে নোমানের জন্ম। ওই বছরই উদ্যোক্তা হিসেবে তাঁর পথচলা শুরু। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে। তবে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত প্রতিষ্ঠান গড়তে ব্যাংকমুখী হননি তিনি। পণ্য উৎপাদনের কাঁচামাল কেনা থেকে শুরু করে নকশা, রঙের ব্যবহার, বিক্রি—সবকিছুই শুরুতে নিজে করেছেন। এখনো বৃদ্ধ বয়সে নকশা, কাঁচামাল কেনা, উৎপাদনের প্রতিটি ধাপের কাজের সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্ত রেখেছেন।

নুরুল ইসলাম বলেন, এখনো দিনরাত মিলিয়ে ১৮ থেকে ২০ ঘণ্টা কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকেন তিনি।

রপ্তানিতে সাফল্য, অর্ধশতকের অপেক্ষা  ১৯৭৬ সাল থেকে ব্যবসা শুরু হলেও নোমান গ্রুপের যাত্রা শুরু হয় ১৯৮৭ সালে। প্রতিষ্ঠার ১৩ বছর পর ২০০০ সালে এসে আন্তর্জাতিক বাজারে নোমান গ্রুপের রপ্তানি শুরু হয়। এ জন্য প্রতিষ্ঠা করেন জাবের অ্যান্ড জোবায়ের ফ্যাব্রিকস নামে রপ্তানিমুখী হোম টেক্সটাইল প্রতিষ্ঠান। ২০০০ সালে রপ্তানি শুরুর পর থেকে এ পর্যন্ত নোমান গ্রুপের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান সেরা রপ্তানিকারক িহসেবে ৪৬টি জাতীয় রপ্তানি পদক পেয়েছে। এরমধ্যে ১১টি ছিল শীর্ষ রপ্তানিকারকের স্বীকৃতি। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) সহায়তায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এ স্বীকৃতি দিয়েছে।

নোমান গ্রুপের বর্তমান চেয়ারম্যান এ এস এম রফিকুল ইসলাম বলেন, সর্বশেষ ২০১৬-১৭ অর্থবছরের জন্য শীর্ষ রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান হিসেবে জাবের অ্যান্ড জোবায়ের ফেবিক্স দুটি স্বর্ণপদক পেয়েছে। এ ছাড়া নোমান গ্রুপের আরও দুটি সহযোগী প্রতিষ্ঠান স্বর্ণপদক ও ব্রোঞ্চপদকসহ মোট চারটি পদক পেয়েছে।

গ্রুপটির উদ্যোক্তা ও কর্মীদের আশা, সবকিছু ঠিক থাকলে আগামী দুই বছরের মধ্যে সেরা রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান হিসেবে সরকারের কাছ থেকে অর্ধশতক পদক জিতবে প্রতিষ্ঠানটি। এখন প্রতিষ্ঠানটির অপেক্ষা সেরা রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান হিসেবে অর্ধশতক পদকপ্রাপ্তি ও ধারাবািহক অবস্থান ধরে রাখা। নোমান গ্রুপের সেরা রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে শীর্ষে জাবের অ্যান্ড জোবায়ের ফ্যাব্রিকস। এ প্রতিষ্ঠানটি গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা নুরুল ইসলামের দ্বিতীয় ও তৃতীয় ছেলের নামে নামকরণ করা হয়েছে।

এ এস এম রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘১৯৯৪ সালে যাত্রা শুরু হয় জাবের অ্যান্ড জোবায়ের ফ্যাব্রিকসের। শুরু থেকেই আমাদের লক্ষ্য, রপ্তানিতে দেশের সেরা হওয়া। প্রথম রপ্তানি শুরু হয় ২০০০ সালে। সেই বছর ৬৫ লাখ ডলারের পণ্য রপ্তানি করে ইউরোপের বাজারে। প্রথম রপ্তানি পণ্য ছিল বিছানার চাদর বা বেডশিট। দেড় যুগের ব্যবধানে প্রতিষ্ঠানটির রপ্তানির পরিমাণ বেড়েছে প্রায় ৩৮ গুণ। সর্বশেষ ২০১৮ সালে জাবের অ্যান্ড জোবায়ের বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রায় সাড়ে ১৬ কোটি ডলার বা এক হাজার ৪০০ কোটি টাকার পণ্য রপ্তানি করেছে।’

জাবের অ্যান্ড জোবায়েরের বর্তমানে ১৮ থেকে ২০ ধরনের পণ্য যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, জাপান, অস্ট্রেলিয়া ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হয়। প্রতিষ্ঠানটির পণ্যের বড় ক্রেতাদের মধ্যে রয়েছে আইকিয়া, এইচঅ্যান্ডএম, ওয়ালমার্ট, টার্গেট, কেমার্ট, ক্যারিফোর ইত্যাদি।

নোমান গ্রুপের ৬৫ হাজার কর্মীর মধ্যে ১২ হাজার জাবের অ্যান্ড জোবায়েরের। প্রতিষ্ঠানটি সম্পর্কে গ্রুপের চেয়ারম্যান আরও বলেন, ‘শুরু থেকে পণ্যের গুণগত মান নিশ্চিত করার প্রতি ছিল আমাদের সর্বোচ্চ মনোযোগ। এ কারণে এখন পর্যন্ত আমাদের পণ্য নিয়ে গ্রাহকের কোনো অভিযোগ নেই।’

জাবের অ্যান্ড জোবায়েরের ধারাবাহিক সাফল্যের জন্য প্রতিষ্ঠানটির বিশাল কর্মী বাহিনীর পাশাপাশি বিক্রয় ও বিপণন বিভাগের কর্মীদের অবদানের কথা জানালেন এ এস এম রফিকুল ইসলাম।

বিপুল ক্ষতি, তবু হাল ছাড়েনি

২০০৯ সালে টেরিটাওয়েল, ডেনিম, উইভিংসহ সাতটি কারখানা গড়ে তোলে নোমান গ্রুপ। ব্যাংকঋণ ও নিজেদের অর্থে গাজীপুরে এসব কারখানা গড়ে তোলা হয়। কিন্তু গ্যাস সরবরাহ না পাওয়ায় সাত বছর উৎপাদন শুরু করা যায়নি এসব কারখানায়। শিল্পের চাকা না ঘুরলেও ব্যাংকঋণের সুদের চাকা ঠিকই সচল ছিল। তাতে বিপুল লোকসান গুনতে হয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে।

নোমান গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ও বর্তমান চেয়ারম্যান উভয়ে জানান, সাত কারখানা গড়ে তোলার পর সাত বছর ধরে এসব কারখানায় উৎপাদন শুরু করতে না পারায় শুধু বসে বসে ২ হাজার কোটি টাকার ব্যাংক সুদ গুনতে হয়েছে। যন্ত্রপাতিও কিছু কিছু পুরোনো হয়ে গেছে। তখন অনেকে বলেছিলেন কারখানাগুলো বিক্রি করে দিতে। কিন্তু সংকটে দমে যাওয়ার পাত্র নন কেউই। কারণ, তাঁরা জানতেন, ব্যবসায় ভালো সময়, খারাপ সময় থাকবেই। ধৈর্য নিয়ে পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হবে। নোমান গ্রুপ তাই করেছে। সেই ধৈর্যের সুফল মিলেছে ২০১৫ সালে এসে। সাত বছর পর মিলেছে গ্যাস–সংযোগ, তাতে চালু হয় কারখানাগুলো।

এ ছাড়া ২০১১ সালে বিশ্ববাজারে হঠাৎ করে তুলার দামে অস্থিরতা দেখা দেওয়ায় সে বছর ৮০০ কোটি টাকার বেশি লোকসান হয় নোমান গ্রুপের। কিন্তু কোম্পানিটি ব্যাংকঋণের চেয়ে নিজেদের অর্থে বিনিয়োগের নীতিকে বেশি গুরুত্ব দেয়। এ কারণে বড় ধরনের লোকসানের পরও ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব হয়েছে বলে মনে করেন গ্রুপটির কর্ণধারেরা।

যে ব্যবসা বুঝি না, তা নয়

নোমান গ্রুপের ৩২টি প্রতিষ্ঠানের সব কটি পোশাক ও বস্ত্র খাতের। সব কটিই ব্যবসা সফল। তারপরও অন্য খাতের কোনো ব্যবসায় নিজেদের যুক্ত করলেন না কেন? জানতে চাই গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা নুরুল ইসলামের কাছে। জবাবে তিনি বলেন, জীবনের বড় অংশই আমি কাটিয়েছি পোশাক ও বস্ত্র খাতের ব্যবসার সঙ্গে। কীভাবে তুলা থেকে সুতা হয়, সুতা থেকে কাপড়। কতটুকু তুলায় কত সুতা আর কত সুতায় কতটুকু কাপড় হয়—সব খুঁটিনাটি আমি জানি। এমনকি কোন মেশিনে কেমন উৎপাদন, খরচ কত কম হয়, তা–ও জানা রয়েছে আমার। তাই এ খাতের ব্যবসায় সবচেয়ে বেশি মনোযোগী হয়েছি। যে ব্যবসা আমি বুঝি না বা কম বুঝি, সেই ব্যবসা করার পক্ষপাতী আমি নই। সন্তানদেরও বলেছি, যে ব্যবসা বুঝবে না, সেই ব্যবসায় না জড়াতে। কারণ, তাতে ক্ষতির আশঙ্কা থাকে।

নুরুল ইসলাম আরও বলেন, ‘আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলো এমনভাবে পরিচালিত হয়, যেখানে প্রয়োজনের বেশি পণ্য তৈরি হয় না। এ কারণে আমাদের কারখানাগুলোতে পণ্যের অপচয় কম হয়। চাহিদা বুঝে আমরা পণ্য উৎপাদন করে থাকি।’

ভবিষ্যৎ ভাবনা

এ এস এম রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘ভবিষ্যতে আমাদের সিনথেটিক কাপড়, পলিয়েস্টার ও সিনথেটিকস নির্ভর ফ্যাব্রিকস তৈরিতে বড় বিনিয়োগের পরিকল্পনা রয়েছে। নিজেদের ব্যবসাকে পোশাক ও বস্ত্র খাতের মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখে নতুন নতুন পণ্য উৎপাদন ও বাজারজাত করার পরিকল্পনা আমাদের। পাশাপাশি রপ্তানির পরিমাণ বৃদ্ধির মাধ্যমে শীর্ষ রপ্তানিকারকের স্বীকৃতি ধরে রাখতে বদ্ধপরিকর।

এ ছাড়াও আরও কিছু কিছু কারণ বাংলাদেশে তৈরি পোশাক শিল্প গড়ে ওঠার পেছনে অবদান রেখেছে। কোনো কোনো দেশ যেমন শ্রীলঙ্কা এবং দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় শ্রম মজুরি দ্রুত বেড়ে যায়। ক্রেতারা বিকল্পের সন্ধানে ছোটে। শান্তিপূর্ণ কাজের পরিবেশ, সস্তা শ্রম এবং বড় আকারের কোটা সুবিধা প্রাপ্তির কারণে বাংলাদেশ আদর্শ স্থান হিসেবে বিবেচিত হয়। ইইউ কোটামুক্ত সুবিধা এবং জিএসপি’র মর্যাদা দেয়া অব্যাহত রাখে। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র এবং কানাডা উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কোটা বরাদ্দ দেয়। এই সুবিধাসমূহই যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা এবং ইইউতে বাংলাদেশের পণ্যের বাজার নিশ্চিত করে।

অভ্যন্তরীণ যে কারণটি তৈরি পোশাক বা আরএমজি গড়ে ওঠার পিছনে অবদান রেখেছে তা হলো তুলনামূলক সুবিধা। আর এই সুবিধার কারণ সস্তা শ্রম এবং পর্যাপ্ত পরিমাণে প্রশিক্ষণযোগ্য শ্রমিকের সরবরাহ। সরকারের অভ্যন্তরীণ নীতিমালাও এই শিল্প গড়ে ওঠার পিছনে অবদান রেখেছে। সরকারের সুযোগ সুবিধার মধ্যে ব্যাক-টু-ব্যাক এল.সি (লেটার অব ক্রেডিট)। পণ্য গুদামজাতকরণ সুবিধা (শুল্ক আদায় সাপেক্ষে) হ্রাসকৃত সুদে ঋণ, নগদ রপ্তানি সুবিধা, রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতকরণ এলাকা তৈরি ইত্যাদি। এছাড়াও আমদানি রপ্তানি নীতিমালা গতিশীল করতে সরকার অনেকগুলি বাস্তবমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করে।

তৈরি পোশাক শিল্পে এখনো বেশ কয়েকটি দুর্বলতা বিরাজমান। শ্রম উৎপাদনশীলতায় প্রতিযোগী দেশের তুলনায় বাংলাদেশ পিছে পড়ে আছে। একদিকে যেমন বাংলাদেশি শ্রমিকদের দক্ষতা হংকং, দক্ষিণ কোরিয়া এবং অপরাপর দেশের তুলনায় কম, তার উপর অধিকাংশ কারখানায় ব্যবহূত মেশিন আধুনিক নয়। এর অর্থ পোশাক তৈরিতে খরচ যতটা কম মনে হয় আসলে বাস্তবে ততটা নয়। এই শিল্পের অপর দূর্বলতম দিক হলো কাঁচামালের জন্য অতিমাত্রায় আমদানি নির্ভরতা এবং অনুন্নত অবকাঠামো। অপর্যাপ্ত বিদ্যুৎ সরবরাহ এবং অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থাও এই শিল্প বিকাশের পথে বাধা। এছাড়াও বন্দরে অপর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধা এবং অব্যবস্থার কারণে ঘন ঘন জটের সৃষ্টির ফলে পণ্য চালানে অহেতুক বিলম্ব হয় এবং এতে খরচ বেড়ে যায়।

এমএফএ’র প্রয়োগ অনেক পোশাক রপ্তানিকারক দেশের উপর ঋণাত্মক প্রভাব ফেলেছে। এই সমস্ত ক্ষতিগ্রস্ত দেশই বস্ত্র ও পোশাককে গ্যাট-এ একত্রিকরণ করে রপ্তানির সুযোগ রহিত করার জন্য আইএমএফ’র চাপ সৃষ্টি করেছে। ফলে উরুগুয়ে রাউন্ড আলোচনা-পর্যালোচনা করে ২০০৪ সাল থেকে এমএফএ তুলে দেওয়া হয়েছে। এমএফএ উঠে যাওয়ার পর বিশ্ব বাজারে বাংলাদেশের অবস্থানে পরিবর্তন এসেছে। এখন সীমার অধীনে থাকাসহ সকল দেশ কোটামুক্ত মর্যাদা ভোগ করছে।

১৯৯১ সাল আর এক জায়ান্টের আবির্ভাবের বছর। বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্পের ইতিহাসে যত গুলো নাম উজ্জল হয়ে আছে তার মধ্যে ডিবিএল গ্ৰুপ অন্যতম।

বাংলাদেশে একের পর এক পোশাক কারখানা গড়ে উঠেছে। নব্বইয়ের দশকের বিভিন্ন সময় নিজেদের বাসা বাড়ী কিংবা ভাড়া করা ছোট্ট কারখানা দিয়ে যাত্রা শুরু করা উদ্যোক্তাদের অনেকেই বর্তমানে অনেকগুলো পোশাক কারখানার মালিক। অনেকে আবার পোশাক কারখানা দিয়ে শুরু করে অন্যান্য খাতেও ব্যবসায়িকভাবে সফল হয়েছেন। এ পর্যায়ে আমরা দুলাল ব্রাদার্স বা ডিবিএল গ্রুপের সফলতার কথা একটুখানি বলতে পারি।

বাবার দেওয়া ৬০ লাখ টাকা পুঁজি নিয়ে নিজেদের পুরোনো বাড়িকে ছোট্ট কারখানায় রূপান্তর করলেন চার ভাই। কিনলেন ৩৭টি সেলাই মেশিন। কয়েক দিন সকাল-বিকেল আশপাশের বিভিন্ন কারখানা ফটকে দাঁড়িয়ে জোগাড় করলেন শতাধিক শ্রমিক। অন্য কারখানা থেকে ঠিকায় কাজ (সাবকন্ট্রাক্টটিং) আনলেন। পোশাক তৈরির পর ডেলিভারি হলো। বছর দুয়েক এভাবেই চলল। কিন্তু কঠোর পরিশ্রম করেও দুই বছরে লাভের মুখ দেখলেন না চার ভাই।

মুনাফা না হলেও পণ্যের মান ও সময়মতো তা বুঝিয়ে দিয়ে অল্প দিনেই দু-চারজন ক্রেতার সুনজরে পড়লেন চার ভাই। ফলে ১৯৯৩ সালে যুক্তরাজ্যের এক ক্রেতার কাছ থেকে সরাসরি ক্রয়াদেশ পেলেন তাঁরা। তিন হাজার পিস পলো শার্ট। তারপর চার ভাইকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। ২৯ বছরের ব্যবধানে পোশাকশিল্পের শীর্ষ রপ্তানিকারকদের অন্যতম তাঁরা।

১৯৯১ সালে ঢাকার ১০২ গ্রিন রোডে ছোট কারখানা দিয়ে শুরু করা সেই প্রতিষ্ঠানটি আজকের দুলাল ডিবিএল গ্রুপ। আর সেই চার ভাই হলেন আবদুল ওয়াহেদ, এম এ জব্বার, এম এ রহিম ও এম এ কাদের। তাঁরা যথাক্রমে ডিবিএল গ্রুপের চেয়ারম্যান, ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি), ভাইস চেয়ারম্যান ও উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি)।

চার ভাইয়ের বাবা আবদুল মতিনের ট্রেডিং ব্যবসা ছিল। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে ঢাকা থেকে নোয়াখালীর চাটখিলের গ্রামের বাড়িতে চলে যায় পুরো পরিবার। আবদুল ওয়াহেদ (গ্রুপের চেয়ারম্যান) যোগ দেন মুক্তিযুদ্ধে। সে সময় তাঁকে ধরতে আলবদর বাহিনীর লোকজন গ্রিন রোডের বাসায় মাঝেমধ্যেই অভিযান চালাত। অক্টোবরে গ্রাম থেকে ঢাকায় ফিরে আসে পুরো পরিবার। তখন করাচি বিশ্ববিদ্যালয়ে সদ্য ভর্তি হওয়া পরিবারের বড় ছেলে আবদুল কুদ্দুস দুলালও ছিলেন। ১৪ ডিসেম্বর সকালে আলবদর বাহিনী গ্রিন রোডের বাসা থেকে তাঁকে ধরে নিয়ে যায়। ১৭ ডিসেম্বর রায়ের বাজারে বধ্যভূমিতে আবদুল কুদ্দুস দুলালের মৃতদেহ পাওয়া যায়। পরে আজিমপুর কবরস্থানে তাঁকে দাফন করা হয়। মুক্তিযুদ্ধে শহীদ আবদুল কুদ্দুস দুলালের নামেই প্রতিষ্ঠান শুরু করেন ছোট চার ভাই। সেটি আজও ধরে রেখেছেন তাঁরা। এম এ জব্বার বলেন, ‘দুলাল ভাইয়ের নামেই আমরা ব্যবসা শুরু করি। সেটিই আমাদের মূল স্পিরিট। আমাদের এক ভাই মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছেন, সেই বিষয়টি সব সময় আমাদের চার ভাইকে দেশের জন্য নতুন কিছু করতে উদ্বুদ্ধ করে।’

যুক্তরাষ্ট্রে পড়াশোনা শেষ করে ১৯৮৯ সালে দেশে ফেরেন এম এ জব্বার। শুরুতে বাবার ব্যবসায় বসলেন। বছরখানেক পর সেটি মন দিয়ে করলেন। তারপর বাকি তিন ভাইয়ের সঙ্গে নতুন কিছু করার পরিকল্পনা শুরু করলেন। সম্ভাবনা থাকায় তৈরি পোশাক ও চামড়ার ব্যবসা নিয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বললেন। শেষ পর্যন্ত নিজেদের বাড়িতেই ছোট পোশাক কারখানা করার মনস্থির করলেন। তত দিনে পাশের আরেকটি বাসায় তাঁরা বসবাস করেন। চাচাতো এক ভাই পোশাকের ব্যবসায় জড়িত থাকায় কাজটি কিছুটা সহজ হলো।

কারখানা চালুর পর ঠিকায় ক্রয়াদেশ আনা থেকে শুরু করে উৎপাদন—শেষ পর্যন্ত চার ভাই কঠোর পরিশ্রম করছেন। তবে দিনের পর দিন লাভের মুখ দেখতে না পেয়ে একসময় হতাশা পেয়ে বসে তাঁদের। তখন বাবা আবদুল মতিন ও মা জিন্নাতের নেসা পাশে এসে দাঁড়ান। এম এ জব্বার স্মৃতিচারণা করলেন এভাবে, ‘ব্যবসায় নিয়ে আমরা চার ভাই মাঝেমধ্যেই উদ্বিগ্ন হয়ে যেতাম। কারণ, এটি ঠিকমতো কাজ করছিল না। এই ব্যবসা করা যাবে না—এমন কথাও মনে হয়েছে। তবে মা–বাবা আমাদের সব সময় সাহস দিতেন। তখন বোনেরাও নানাভাবে সহায়তা করেছেন।’

সরাসরি ক্রয়াদেশ পাওয়ার পর থেকেই ধীরে ধীরে ভিত শক্ত হতে থাকে ডিবিএলের। ব্যবসা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে কারখানাও ওপর দিকে উঠতে থাকল। তারপর ১৯৯৯ সালে গাজীপুরের কাশিমপুরে বড় বিনিয়োগ করলেন চার ভাই। সেখানে ধাপে ধাপে পোশাক কারখানার পাশাপাশি নিটিং, ডায়িং, অল ওভার প্রিন্ট সেকশন চালু করলেন তাঁরা। সে সময় অধিকাংশ পোশাক ব্যবসায়ী তাঁদের কারখানায় ভারতীয় ও কোরিয়ান মেশিন ব্যবহার করতেন। তাতে খরচ কম পড়ত, সহজেই বিনিয়োগ উঠে আসত। তবে ডিবিএল কাশিমপুরের কারখানার জন্য ইউরোপের সর্বশেষ প্রযুক্তির যন্ত্রপাতি আনলেন। তাতে প্রাথমিকভাবে বিনিয়োগ বেশি হলেও পণ্যের মানের দিক এগিয়ে গেল চার ভাইয়ের ব্যবসা।

পশ্চাৎমুখী শিল্প বা ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজে বিনিয়োগ করার সিদ্ধান্তই ডিবিএলের ব্যবসা আজকের উচ্চতায় পৌঁছতে সহায়তা করেছে বলে মনে করেন এম এ জব্বার। হাসতে হাসতে বলেন, ‘আমরা যখন কাশিমপুরে বড় বিনিয়োগে গেলাম তখন অনেকেই বলেন, এত বিনিয়োগ কেন করছ? তোমরা কি বিনিয়োগের অর্থ তুলে আনতে পারবে? কিন্তু আমরা আত্মবিশ্বাসী ছিলাম। দীর্ঘদিন পোশাক সেলাই করার পর আমাদের মনে হয়েছিল, ক্রেতাদের সহায়তা দেওয়ার জন্য ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজে বিনিয়োগ করতে হবে। সেই সিদ্ধান্ত আমাদের ব্যবসার টার্নিং পয়েন্ট।’

টি–শার্ট ও পলো টি–শার্টের মতো সস্তা পোশাক দিয়ে শুরু করলেও বর্তমানে মধ্য ও উচ্চ মূল্যের পোশাক উৎপাদন করছে ডিবিএল। বাচ্চাদের পোশাকও করে তারা। নিজেদের ডিজাইন সেন্টারে পোশাকের নকশা করে ক্রেতাদের কাছ থেকে ক্রয়াদেশ আনছে। এ ছাড়া ব্যবহৃত ও পুরান কাপড় থেকে সুতা ও কাপড় উৎপাদনের কাজ করছে ডিবিএল গ্রুপ।

২০০৮ সালে হঠাৎ করে ডিবিএল গ্রুপের ভাইয়েরা চিন্তা করতে থাকেন ব্যবসা কীভাবে টেকসই (সাসটেইনেবল) করা যায়। বহু চিন্তাভাবনার পর তাঁরা একটা পরিকল্পনা করলেন। তিন বছর পর সেটির অংশ হিসেবে ক্লিনার প্রোডাকশন প্রকল্প নিলেন। সেটির অধীনে কাপড় রং করার পুরো প্রক্রিয়ায় পানির ব্যবহার কমিয়ে আনলেন। আগে যেখানে এক কেজি কাপড় ডায়িংয়ে দেড় শ লিটার পানি লাগত, সেটি নেমে এল ৬০ লিটারে। একইভাবে তাঁরা ডায়িং মেশিনের তাপমাত্রা ১০০ থেকে ৬০ ডিগ্রিতে নামিয়ে আনার পাশাপাশি রাসায়নিক ব্যবহার হ্রাস করলেন ব্যাপকভাবে।

ডিবিএলের কর্মীর সংখ্যা বর্তমানে ৩৬ হাজার। এম এ জব্বার বলেন, ‘প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের আমরা পরিবারের সদস্য হিসেবেই মনে করি। শুরু থেকেই ব্যবসার ভবিষ্যতের পাশাপাশি পরিবারের সদস্যদের ভবিষ্যৎ নিয়েও চিন্তা করেছি। ২০০৮ সালে যখন মূল্যস্ফীতি অস্বাভাবিক হারে বেড়ে গেল, তখন আমরা কারখানায় বন্ধন নামে মুদি দোকান দিলাম। সেখানে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য সরাসরি পাইকার কিংবা কারখানা থেকে কিনে এনে সেই দামেই বিক্রি করা হয়। কর্মীরা বাকিতে পণ্য নিয়ে যান। পরে তাঁর বেতনের সঙ্গে সেই অর্থ সমন্বয় করা হয়। আমাদের প্রতিটি কারখানাতেই এই ব্যবস্থা আছে। এটি এখন আমাদের স্ট্যান্ডার্ড হয়ে গেছে।’

দেশে নতুন করে বড় ধরনের বিনিয়োগে যাচ্ছে ডিবিএল। শ্রীহট্ট অর্থনৈতিক অঞ্চলে ও মিরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিনিয়োগ করছে প্রতিষ্ঠানটি। সেখানে নতুন পোশাক কারখানা ও কাঁচামাল উৎপাদনের জন্য কারখানা করবে তারা।

পোশাকের ব্যবসা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে একের পর এক কারখানা করেছে ডিবিএল। তো কারখানা নির্মাণের সময় দেখা গেল, সময়মতো টাইলস দিতে পারছে না সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান। নতুন সমস্যা। সমাধান কী? তখন ভাবতে ভাবতে নিজেরাই সিরামিক টাইলস কারখানা করার পরিকল্পনা করলেন চার ভাই। যেই ভাবা সেই কাজ টাইলসের বাজারের সম্ভাব্যতা যাচাই শেষে গাজীপুরের মাওনায় ৩০ একর জমির ওপর ডিবিএল সিরামিক কারখানা নির্মাণ করে। উৎপাদন শুরু হয় ২০১৭ সালের এপ্রিলে। কারখানাটির উৎপাদন সক্ষমতা দিনে ৪৫ হাজার বর্গমিটার টাইলস। দেশের বাজারে সরবরাহের পাশাপাশি শিগগিরই তারা টাইলস রপ্তানিতেও যাবে।

ওষুধ ব্যবসায় আসার পেছনেও এমন এক গল্প আছে। সামাজিক দায়বদ্ধতার অংশ হিসেবে চার ভাই ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ বিভিন্ন হাসপাতালে দীর্ঘদিন ধরে সহযোগিতা করেন। একবার ঢাকা মেডিকেল পরিদর্শনে গেলেন চার ভাই। বিভিন্ন ওয়ার্ড ঘুরতে ঘুরতে তাঁদের মনে হলো, রোগীরা সঠিক ওষুধ পাচ্ছে না। নামীদামি ওষুধ কোম্পানিগুলো বিষয়টি নিয়ে কাজ করছে না। তখনই ভালো কিছু ওষুধ উৎপাদনের চিন্তা মাথায় ঢুকে গেল চার ভাইয়ের।

পোশাকশিল্পে নতুন বিনিয়োগের সম্ভাবনা কতটুকু। জানতে চাইলে ডিবিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, ‘বিশ্বে পোশাক রপ্তানিতে দ্বিতীয় শীর্ষ অবস্থানে আছে বাংলাদেশ। গত অর্থবছরে আমরা রপ্তানি করেছি ৩ হাজার ৪০০ কোটি ডলার। আর শীর্ষস্থানে থাকা চীন করছে ১৫ হাজার ৮০০ কোটি ডলার। ফলে এখনো বাংলাদেশের বড় ধরনের সম্ভাবনা আছে। তা ছাড়া তৈরি পোশাকে বিনিয়োগ করার ক্ষেত্রে সবদিক দিয়েই বাংলাদেশ বর্তমানে উপযুক্ত জায়গা।’

শুরু থেকেই চার ভাই ব্যবসা করেছেন। কখনো আলাদা হওয়ার কথা ভাবেননি। একসঙ্গে ব্যবসা করাটাই শক্তি বলে মনে করেন চার ভাই। এমনটাই বলেন এম এ জব্বার। তাঁর ভাষায়, ‘আমাদের বাবা-চাচারা একসঙ্গে ব্যবসা করেছেন। আমরা দেখেছি, চাচা বাবাকে কীভাবে সম্মান করেন। আমার ভাইদের মধ্যে প্রথম থেকেই ছাড় দেওয়ার মনোভাব ছিল। কে কম নেবে, কে বেশি নেবে সেটি নিয়ে কেউ কখনোই ভাবেনি। যার যতটুকু দরকার সে ততটুকুই নিয়েছে। আর প্রত্যেকেই একসঙ্গে থাকার সুবিধা বোঝে ও বিশ্বাস করে, একসঙ্গে ব্যবসা করাটাই শক্তি।’

পোশাক দিয়ে শুরু হলেও গত ২৯ বছরের ব্যবসায় সিরামিক টাইলস, তথ্য প্রযুক্তি, টেলিযোগাযোগ ও ড্রেজিং ব্যবসায় নাম লিখিয়েছে ডিবিএল। শিগগিরই তারা দেশে ওষুধ ব্যবসায়ও আসছে। সব মিলিয়ে ডিবিএল গ্রুপের প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বর্তমানে ২৪টি। এসব প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন ৩৬ হাজার কর্মী। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে গ্রুপের বার্ষিক লেনদেন ছিল প্রায় ৬০ কোটি মার্কিন ডলার, যা দেশীয় মুদ্রায় ৫ হাজার ১০০ কোটি টাকার সমান। এর মধ্যে তৈরি পোশাক ব্যবসা থেকেই এসেছে ৯০ শতাংশ অর্থ। সব মিলিয়ে গ্রুপটির বিনিয়োগের পরিমাণ ৬ হাজার কোটি টাকার বেশি।

করোনাকালে অনেক প্রতিষ্ঠান যেখানে টিকে থাকতে সংগ্রাম করছে

সেখানে নতুন বিনিয়োগের পথে হাঁটছে দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্পগোষ্ঠী দুলাল ব্রাদার্স লিমিটেড বা ডিবিএল। মহামারির এই সময়ে বস্ত্র ও সিরামিক খাতে তারা নতুন করে বিনিয়োগ করছে ৯১২ কোটি টাকা। এতে ২ হাজার ১৭৫ মানুষের কর্মসংস্থান হবে।

দেড় বছর ধরে চলমান মহামারিতে তৈরি পোশাক ও বস্ত্র খাতের ব্যবসায় চ্যালেঞ্জের পাশাপাশি সুযোগও তৈরি হয়েছে। সেটি কাজে লাগাতে ডিবিএল গ্রুপ তাদের মতিন স্পিনিং মিলসের ব্যবসা সম্প্রসারণ করছে। বিদ্যমান ইউনিটের পাশাপাশি নতুন করে স্পেশাল ইয়ার্ন ইউনিট স্থাপন করছে প্রতিষ্ঠানটি। নতুন এ ইউনিটে ম্যানমেইড ফাইবার বা কৃত্রিম তন্তুসহ বিশেষায়িত বেশ কিছু সুতা উৎপাদন হবে। তার জন্য বিনিয়োগ হচ্ছে ২ কোটি ১৯ লাখ মার্কিন ডলার, যা দেশীয় মুদ্রায় প্রায় ১৮৬ কোটি টাকা। ৪ শতাংশ সুদে এই অর্থ ঋণ হিসেবে দিচ্ছে জার্মান ডেভেলপমেন্ট ফাইন্যান্স ইনস্টিটিউট (ডিইজি)।

এ ছাড়া ডিবিএল গ্রুপ তাদের হামজা টেক্সটাইলের দ্বিতীয় ইউনিটে বিশেষায়িত সুতা-কাপড় ডায়িং ও ফিনিশিংয়ের জন্য ৪ কোটি ৪৩ লাখ ডলার বা ৩৭৬ কোটি টাকা বিনিয়োগ করছে। ৪ শতাংশ সুদে এই অর্থ দিচ্ছে ইন্টারন্যাশনাল ফিন্যান্স করপোরেশন (আইএফসি)।

নতুন এই দুই ইউনিটে বিনিয়োগে প্রায় ২ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হবে। রপ্তানিও বাড়বে। চলতি বছরই সম্প্রসারিত দুই ইউনিটের উৎপাদন শুরু হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সেটি হলে কৃত্রিম তন্তু উৎপাদনে আরেক ধাপ এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ। খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, আগামী দিনে কৃত্রিম তন্তুর পোশাকই বিশ্বব্যাপী ছড়ি ঘোরাবে। এ কারণে প্রতিযোগী অনেক দেশ কৃত্রিম তন্তুতে বড় ধরনের বিনিয়োগ করলেও বাংলাদেশে এখনো এ খাতে আশানুরূপ বিনিয়োগ হচ্ছে না। এম এ জব্বার বলেন, ‘কাশিমপুরে হামজা টেক্সটাইল ও মতিন স্পিনিংয়ের সম্প্রসারিত ইউনিট দুটি যথাক্রমে আগস্ট ও ডিসেম্বরে উৎপাদনে যাবে। ম্যানমেইড ফাইবার, ব্লেন্ডসহ আমাদের কিছু উদ্ভাবিত সুতা নতুন কারখানায় উৎপাদন হবে। তা ছাড়া ডায়িং ইউনিটে পলিস্টার ও সিনথেটিক কাপড় রং করা হবে। কিছু বিশেষ ধরনের ফিনিশিং প্রক্রিয়াও থাকবে সেখানে।

বাংলাদেশকে এখন অনেক শক্তিশালী দেশের সাথে প্রতিযোগিতা করতে হচ্ছে। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বাংলাদেশ ইতোমধ্যে বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। তন্মধ্যে পণ্য এবং বাজার বহুমুখীকরণ, অবকাঠামোগত অসুবিধা দূরীকরণ, পণ্য সরবরাহে ক্ষমতা বৃদ্ধি, উৎপাদন খরচ হ্রাসে কৌশল গ্রহণ এবং পশ্চাৎ সংযোগ সম্প্রসারণের মাধ্যমে মূল্য সংযোজন বৃদ্ধি।

তৈরি পোশাক শিল্পের জন্য পশ্চাৎ-অন্বয়ী শিল্পসমূহের মধ্যে আছে বস্ত্রবয়ন, সেলাইয়ের সুতা কাটা, রং করা, ছাপ মারা এবং ফিনিশিং। এসব কাজ কম্পোজিট মিলে একত্রে সম্পন্ন করা যায় অথবা করা যায় পৃথকভাবে, আলাদা আলাদা ইউনিটে। বর্তমানে বাংলাদেশি পোশাক রপ্তানিকারকরা পিঠাপিঠি (back to back) প্রত্যয়নপত্র ব্যবহার করে আন্তর্জাতিক মূল্যে বস্ত্র আমদানি করে।

এই প্রক্রিয়ায় আমদানিকারকরা অর্থাৎ বাংলাদেশি পোশাক রপ্তানিকারকরা উচ্চহারে সুদ ও অন্যান্য চার্জ, কমিশন ও মধ্যস্থ কারবারিদের ফি পরিশোধ করে। বস্ত্র বয়ন, সুতা কাটা (স্পিনিং) এবং প্রক্রিয়াকরণের জন্য কম্পোজিট কারখানা স্থাপিত হলে অর্ডার গ্রহণ ও সে অনুযায়ী তৈরি পোশাক সরবরাহের মধ্যবর্তী সময়ের ব্যবধান কমে যাবে, মূল্য সংযোজন ও কর্মসংস্থান বাড়বে এবং বলাবাহুল্য, উৎপাদন ব্যয়েও সাশ্রয় হবে। পঞ্চম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় (১৯৯৭-২০০২) বাংলাদেশ সরকার স্পিনিং-এর সম্প্রসারণের মাধ্যমে সেলাইয়ের সুতা উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিল।

তাতে স্পিনিং খাতের উৎপাদনক্ষমতা পর্যাপ্ত পরিমাণে বাড়লেও তা চাহিদার তুলনায় এখনও অপ্রতুল।

বাংলাদেশে এখন ১৪২টি রিং স্পিনিং মিল এবং ১৫টি ওপেন-অ্যান্ড স্পিনিং মিলসহ ১,১২৬টি বয়ন ও স্পিনিং কারখানা আছে। এগুলি মূলত অভ্যন্তরীণ বাজারের জন্য উৎপাদন করে। উৎপাদিত মোট বস্ত্রের মাত্র ২৫% দেয় আধুনিক কারখানাসমূহ, অভ্যন্তরীণভাবে উৎপাদিত বাকি বস্ত্রের যোগান দেয় বিশেষায়িত ইউনিট, বিদ্যুৎচালিত তাঁত এবং হস্তচালিত তাঁতসমূহ। দেশিয় উৎপাদন রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক শিল্পের জন্য ওভেন খাতের মোট চাহিদার ৮ শতাংশেরও কম মেটাতে পারে, আর নিট বস্ত্রের চাহিদা মেটাতে পারে প্রায় ৪০%।

বাংলাদেশ সীমিত কয়েক শ্রেণীর তৈরি পোশাক রপ্তানি করে থাকে। বাংলাদেশের কারখানাগুলি প্রধানত শার্ট, জ্যাকেট ও পায়জামা তৈরি করে এবং মোট তৈরি পোশাকের প্রায় ৬০% শার্ট, যা রপ্তানি করা হয় কম দামে। বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বয়স্ক পুরুষ ও শিশু-কিশোরদের সুতি শার্টের প্রধান রপ্তানিকারক। এই বাজারে নিম্নমূল্যে পণ্য বিক্রয়ে বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা করে ভারত, শ্রীলঙ্কা, মেক্সিকো এবং সেন্ট্রাল আমেরিকার অন্যান্য দেশের সাথে। বাংলাদেশ ১৯৯৮ সালে ডজন প্রতি ৬২.৭৪ ডলারে শার্ট বিক্রয় করত। এই মূল্য ছিল দ্বিতীয় নিম্নতম। ডোমিনিকান রিপাবলিক একই ধরনের শার্ট বিক্রয় করতো সর্বনিম্ন মূল্য প্রতি ডজন ৫৪.৭৯ ডলারে। ভারতীয়, মেক্সিকান এবং শ্রীলঙ্কার শার্টের মূল্য ছিল ডজন প্রতি ৮১.০৪ ডলার, ৭৬.২৬ ডলার এবং ৭৪.৭৭ ডলার।

অপরদিকে হংকং এবং মালয়েশিয়ার শার্টের মূল্য ছিল ডজন প্রতি ১০৭.৩৪ ডলার এবং ১৩৪.০৮ ডলার। বাংলাদেশের রপ্তানিকারকরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে কোটা দ্বারা নির্ধারিত ধরনের পোশাক প্রস্ত্তত করত। তবে, বেশ কিছু ব্যতিক্রমও ছিল। দক্ষিণ কোরিয়ার কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ঢাকা এবং চট্টগ্রাম রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতকরণ এলাকা থেকে প্যাডেড জ্যাকেট এবং ট্রাউজার্স উচ্চমূল্যে রপ্তানি করত। বর্তমানে অনেক প্রতিষ্ঠান কিছু কোটা-বহির্ভূত আইটেম রপ্তানি করে থাকে। এসব আইটেমের পরিমাণ খুবই কম। সম্প্রতি বুনন কাপড়ের পোশাকের চেয়ে নিটওয়্যার এবং সোয়েটারের রপ্তানি অধিকতর দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এতে বোঝা যায়, বাংলাদেশ তৈরি পোশাক উৎপাদনে বৈচিত্র্যায়ন ঘটাচ্ছে।

বাংলাদেশ প্রায় ৩০টি দেশে তৈরি পোশাক রপ্তানি করলেও এর রপ্তানি বাজার মূলত যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নে কেন্দ্রীভূত সবচেয়ে বড় আমদানিকারক দেশ যুক্তরাষ্ট্র ১৯৯৮-৯৯ সালে বাংলাদেশ থেকে রপ্তানিকৃত তৈরি পোশাকের সর্বমোট ৪৩.২৪% আমদানি করেছে। একই বৎসর যুক্তরাষ্ট্রের পোশাকের বাজারে বাংলাদেশ ছিল ষষ্ঠ বৃহত্তম সরবরাহকারী দেশ। তবে ইউরোপের সবকটি দেশের বাজারকে যদি সমন্বিত একটি একক বাজার হিসেবে ধরে নেওয়া হয়, তাহলে যুক্তরাষ্ট্র পরিণত হবে দ্বিতীয় বৃহত্তম বাজারে। ১৯৯৮-৯৯ সালে ইউরোপীয় পোশাক বাজারে বাংলাদেশ ৫২.৩৮% তৈরি পোশাক রপ্তানি করে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন বাংলাদেশ থেকে নিটওয়্যার রপ্তানির সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ গন্তব্যস্থল। এককভাবে জার্মানি বাংলাদেশে নিটওয়্যার এবং বুননবস্ত্রের পোশাকের বৃহত্তম ইউরোপীয় আমদানিকারক। বাংলাদেশের রপ্তানিকৃত বুননবস্ত্র পোশাকের ১৫.৬% এবং নিটওয়্যারের ১৪.৮% যায় জার্মানিতে এবং এসবের ক্রেতা হিসেবে এর পরের স্থান দুটি যথাক্রমে যুক্তরাজ্য এবং ফ্রান্সের।

ইউরোপীয় ইউনিয়ন একটি ব্লক হিসেবে বাংলাদেশ থেকে ক্রমাগত অধিক পরিমাণে পোশাক আমদানি করে। ১৯৯৫-২০০০ সময়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানি বৃদ্ধির হার ছিল ১৭৪%। এই অভূতপূর্ব প্রবৃদ্ধি হারের প্রধান কারণ মূলত জিএসপি সুবিধার সুবাদে ইউরোপীয় বাজারে প্রায় শুল্কমুক্ত এবং কোটামুক্ত প্রবেশাধিকার। অন্যান্য রপ্তানি বাজার বেশ ছোট। তবে, জাপান এবং আসিয়ান দেশসমূহের বাজারগুলি যথেষ্ট সম্ভাবনাময়। বাংলাদেশ জাপান থেকে পোশাক শিল্পখাতের প্রায় ৯০% মেশিনারিজ আমদানি করলেও জাপানের পোশাক বাজারে বড় আকারের পোশাক রপ্তানিতে সক্ষম হয় নি। একইভাবে, বাংলাদেশ আসিয়ান বাজারে প্রবেশ করতেও সক্ষম হয় নি।

আবার ভারতীয় বাজার থেকে বাংলাদেশ যদিও পর্যাপ্ত পরিমাণে কাপড় এবং সুতা আমদানি করে থাকে, এই দেশের বাজারেও বাংলাদেশের রপ্তানি সীমিত। এর প্রধান কারণ শুল্ক এবং শুল্ক-বহির্ভূত প্রতিবন্ধক ও বিধিনিষেধ। সম্প্রতি বাংলাদেশ ভারত, দক্ষিণ কোরিয়া এবং অন্যান্য কয়েকটি নতুন বাজারে তৈরি পোশাক রপ্তানি শুরু করেছে। সার্ক-এর সদস্য হিসেবে বাংলাদেশ ভারত এবং সার্কের অন্যান্য সদস্য দেশসমূহের পোশাক বাজারে রপ্তানি করার বিস্তারিত কর্মসূচি গ্রহণ করেছে।

একটি বৃহৎ তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক দেশ হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশ অনেকগুলি অসুবিধার সম্মুখীন। যদিও বাংলাদেশ প্রায় ৩০টি দেশে পোশাক রপ্তানি করে, তবে রপ্তানি মূলত যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউ-এর বাজারে কেন্দ্রীভূত যা এই শিল্পের বড় দূর্বলতা। অর্থাৎ মোট রপ্তানির ৯০%-এর অধিক যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউ বাজারে বিক্রি হয়। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে মোট রপ্তানির ৪০% এবং ইইউতে ৫০% রপ্তানি হয়। এই দুই বাজারে বাংলাদেশকে চীন, ভারত, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, তুরস্ক, মেক্সিকো, পূর্ব ইউরোপের দেশ, ল্যাটিন আমেরিকা ও আফ্রিকার সাথে প্রতিযোগিতা করতে হচ্ছে। মেক্সিকো, বেশ কিছু ল্যাটিন আমেরিকার দেশ, আফ্রিকা এবং পূর্ব ইউরোপের দেশ যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে শুল্কমুক্ত রপ্তানির সুযোগ পেলেও বাংলাদেশ পায় নি। এই বৈষম্যের কারণে বাংলাদেশকে তীব্র প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। এই বৈষম্যের কারণে দাম পার্থক্য বাংলাদেশের প্রতিকূলে থাকায় কঠিন প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে। যদি কোনো কারণে একটি বাজার হাতছাড়া হয়ে যায়, তা হলে তৈরি পোশাক শিল্প বড় ধরনের হুমকির সম্মুখীন হতে পারে।

এই প্রতিযোগিতামূলক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বাংলাদেশি উদ্যোক্তারা পণ্য এবং বাজার বহুমুখীকরণের উদ্যোগ নিয়েছে। বেশ কিছু রপ্তানিকারক নতুন কিছু উচ্চ মূল্যের পণ্য রপ্তানির আদেশ পেয়েছে। অনেকেই যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের নিজস্ব বায়িং হাউজ খুলেছে। তারা আর বিদেশি ক্রেতার উপর নির্ভরশীল নয়। কেউ কেউ নিজস্ব ব্র্যান্ডের পণ্য রপ্তানি করছে। বাজার বহুমুখীকরণের পদক্ষেপ হিসেবে ইতিমধ্যেই স্বল্প পরিসরে হলেও ভারত, রাশিয়া, থাইল্যান্ড, জাপান, চীন ও অন্যান্য দেশে পণ্য রপ্তানি শুরু করেছে।

বাংলাদেশে দুটি শীর্ষস্থানীয় বাণিজ্য সংস্থা বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারিং ও এক্সপোর্টিং এ্যাসোসিয়েশন (বিজিএমইএ) এবং বাংলাদেশ নীটওয়ার ম্যানুফ্যাকচারিং এবং এক্সপোর্টিং এ্যাসোসিয়েশন (বিকেএমইএ) সরকারকে সংশ্লিষ্ট নীতিমালা তৈরিতে সহযোগিতা দেয় এবং পণ্য এবং বাজার বহুমুখীকরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। সকল কারখানার মালিক এই সংগঠনের সদস্য।

তৈরি পোশাক শিল্প ইতোমধ্যেই পরিপক্কতা অর্জন করেছে। এই শিল্প আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে শিশু শ্রম বন্ধ, ন্যূনতম মজুরি দেওয়া, ক্রেতাদের পরামর্শ অনুযায়ী কাজের পরিবেশ উন্নত করার ব্যবস্থা নিয়েছে। বেশ কয়েকটি কারখানায় সিবিএ-সহ ট্রেড ইউনিয়ন সক্রিয় আছে।

পোশাক শিল্প খাতে শিশুশ্রমিক বর্জনের আন্তর্জাতিক দাবিতে বাংলাদেশ ইতিবাচক সাড়া দিয়েছে। ১৯৯৪ সালের ৪ জুলাই ঢাকায় বিজিএমইএ, আইএলও, ইউনিসেফ এবং যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস যৌথভাবে এক স্মারকলিপিতে স্বাক্ষর করে এবং বাংলাদেশ ১৯৯৬ সালের নভেম্বর মাস থেকে শিশু শ্রম নিষিদ্ধ করতে অঙ্গীকারাবদ্ধ হয়। এটি সফলভাবে কার্যকর করা হয়। অর্থনৈতিক সমর্থন পেলে শিশুরা ১৫ বছর বয়স পর্যন্ত স্কুলে অংশগ্রহণ করতে পারে। বিজিএমইএ এবং কিছু এনজিও যৌথভাবে শ্রমজীবী শিশুদের জন্য কিছু স্কুল পরিচালনা করছে। কারখানার মালিকদের প্রতি দাবি হলো আইন মেনে চলা, ন্যূনতম মজুরি চালু করা, কাজের পরিবেশ, ইকো-লেবেলিং ইত্যাদি ক্ষেত্রে পোশাক শিল্প শ্রমিকদের দাবি বাস্তবায়ন করা এবং শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন গঠন করার এবং/অথবা ট্রেড ইউনিয়নে অংশগ্রহণ করার অনুমতি দেওয়া। পোশাক শিল্প কারখানাগুলিতে সিবিএ সহ অনেক সক্রিয় ট্রেড ইউনিয়ন রয়েছে। রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতকরণ এলাকাসমূহে অবস্থিত কারখানাগুলিতে ট্রেড ইউনিয়ন নেই। তবে এখানকার কারখানায় কর্মরত শ্রমিকরা উচ্চতর পারিশ্রমিক এবং উন্নত সুবিধাদি ভোগ করে। বিজিএমইএ আন্তর্জাতিক মানদন্ড মেনে চলতে এ শিল্পখাতকে সহায়তা করতে পারে, বিশেষ করে কারখানায় আজু ডাইসহ স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর রঙের কাজ না-করা নিশ্চিত করার মাধ্যমে। বাংলাদেশ এটা স্বীকার করে নিয়েছে যে, তৈরি পোশাক শিল্পের ভবিষ্যতের উপর দেশের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নির্ভর করছে। সুতরাং এমএফএ-উত্তর বিশ্ববাজারের নতুন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার লক্ষ্যে এই ক্ষেত্রে বিস্তারিত কর্মসূচি গ্রহণ করতে হয়েছে।

বাংলাদেশ নিয়ে কয়েকটা কথা বললেও তার মধ্যে একটা হবে এর গার্মেন্টস সেক্টর নিয়ে। বাংলাদেশের রপ্তানি বা বিদেশী মুদ্রার রিজার্ভ গার্মেন্টস সেক্টর ছাড়া চিন্তাও করা যায় না, একইভাবে নারীদের কর্মসংস্থানের কথা আসলেই গার্মেন্টস সেক্টরের কর্মীদের কথা আসবেই। কিন্তু গার্মেন্টস সেক্টর রপ্তানি, বিদেশী মুদ্রার রিজার্ভ বা নারী কর্মীদের জন্য কতখানি গুরুত্বপূর্ণ? এছাড়াও গার্মেন্টস সেক্টর কি শুধুই রফতানি, বিদেশী মুদ্রার রিজার্ভ বা নারী কর্মীদের নিয়েই? এর বাইরে অন্যান্য সেক্টরের উপর গার্মেন্টস সেক্টর এর ইতিবাচক প্রভাব কতখানি?

বাংলাদেশের গার্মেন্টস সেক্টর নিয়ে সবচেয়ে প্রচারিত তথ্য হল এই খাত আমাদের রপ্তানির আয়ে ৮৪ শতাংশেরও বেশি। এটি এই খাতের জন্য যতটা ইতিবাচক তথ্য একটি দেশের জন্যই ঠিক ততটা ইতিবাচক তথ্য না। বরং কিছুটা হলেও নেতিবাচক। এটি পরিষ্কার হবে যদি বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলাদেশের প্রতিযোগী বা সামান্য এগিয়ে বা পিছিয়ে থাকা কিছু রাষ্ট্রের রফতানি তথ্য দেখা যায়।

ইউএন কমট্রেডের তথ্য মতে ২০১৮ সালে; মিয়ানমারের মোট রফতানি আয়ের প্রধান তিনটি পণ্য এবং তাদের অবদান হল গার্মেন্টস ২৫ দশমিক ৪০ শতাংশ, জ্বালানি ২১ দশমিক ৫৬ শতাংশ , সবজি ১৫ দশমিক ৯৭ শতাংশ। থাইল্যান্ডের মোট রফতানি আয়ের প্রধান তিনটি পণ্য এবং তাদের অবদান হল মেশিন ও ইলেকট্রনিক্স ৩০ দশমিক ৯৭ শতাংশ, ভেহিকেল ১৩ দশমিক ১১ শতাংশ, প্লাস্টিক এবং রাবার ১২ শতাংশ ০৭ শতাংশ, ফিলিপিনসের মোট রফতানি আয়ের প্রধান তিনটি পণ্য এবং তাদের অবদান হল- মেশিন অ্যান্ড ইলেক্ট্রোনিক্স ৬৩ শতাংশ, ভেজিটেবল ৫ দশমিক ২৪ শতাংশ, ভেহিকলস ৪ দশমিক ৮৭ শতাংশ, ইন্ডিয়ার মোট রপ্তানি আয়ের প্রধান তিনটি পণ্য এবং তাদের অবদান হল জ্বালানি ১৫ দশমিক ০৭ শতাংশ, কেমিক্যালস ১৩ দশমিক ৮৩ শতাংশ, মূল্যবান পাথর ও গ্লাস ১৩ দশমিক ৩৮ শতাংশ।

বাংলাদেশের ক্ষেত্রে গার্মেন্টস ও টেক্সটাইলস ৮৭ শতাংশ, ফুটওয়্যার ২ দশমিক ৮ শতাংশ, এর মধ্যে শুধু গার্মেন্টস পণ্যের হিসেবে এই অংশ ৮৪ শতাংশ এর বেশি। অর্থাৎ অন্যান্য দেশের মোট রপ্তানি আয়ে তাদের প্রধান তিনটি রপ্তানি পণ্যের মিলিত অবদানও বাংলাশের মোট রফতানি আয়ে তার প্রধানতম পণ্যটির অবদানের ধারেকাছেও নেই। তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল বাংলাদেশে প্রধান রফতানি পণ্যের তালিকার অন্য কোন পণ্যের অবদান ৫ শতাংশও নয়! এই তথ্যগুলো এটাই নির্দেশ করে যে বাংলাদেশের রফতানি আয়ের প্রায় সম্পূর্ণটাই আসে গার্মেন্টস সেক্টর থেকে। শিল্পজাত পণ্য রপ্তানিকারক দেশগুলির মধ্যে একটি পণ্যর উপর এত নির্ভরশীলতা অন্য কোন দেশেরই নেই।

গত দুই বা তিন দশকে বাংলাদেশের মানুষের দারিদ্র্য হ্রাস পাওয়ার পিছনে অনেক কারণ রয়েছে, এর মধ্যে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পাওয়া নিঃসন্দেহে অন্যতম নিয়ামক। ২০১৬/১৭ এর শ্রমশক্তি জরিপের তথ্য মতে বাংলাদেশে মোট শ্রমশক্তি মোট ৬ কোটি ৮ লাখ ২৮ হাজার। এর মধ্যে ইন্ডাস্ট্রিয়াল খাতে নিয়োজিত আছে ১ কোটি ২৪ লাখ ২৪ হাজার। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য মতে ঐ সময়ে গার্মেন্টস সেক্টরে নিয়োজিত ছিল ৪০ লক্ষ মানুষ অর্থাৎ ইন্ডাস্ট্রিয়াল খাতে নিয়োজিত শ্রমশক্তির প্রায় ৩৩ শতাংশ নিয়োজিত আছে গার্মেন্টস সেক্টরে!

নারী কর্মীদের জন্য গার্মেন্টস সেক্টর কতখানি গুরুত্বপূর্ণ? বিবিএসের তথ্য মতে, (২০১৬) মোট গার্মেন্টস কর্মীদের প্রায় ৫৪ শতাংশ হল নারী অর্থাৎ ৪০ লাখের মধ্যে কম বেশি ২২ লাখ কর্মী নারী। এই তথ্যটির গুরুত্ব বেড়ে যায় যখন দেখা যায় ২০১৬/১৭ এর শ্রমশক্তি জরিপের তথ্য মতে ইন্ডাস্ট্রিয়াল সেক্টরে নিয়োজিত মোট নারী কর্মীর সংখ্যা হল ৩১ লাখ ৪৫ হাজার। অর্থাৎ গার্মেন্টস সেক্টরে নিয়োজিত নারী কর্মী দেশের ইন্ডাস্ট্রিয়াল সেক্টরে নিয়োজিত মোট নারী কর্মীর ৭০ শতাংশ।

বাংলাদেশের শিল্প খাতের নিয়োজিত শ্রমশক্তির সংখ্যা কৃষি এবং সেবা খাতের তুলনায় বেশ কম। কিন্তু দেশের জিডিপিতে অবদানের কথা বিবেচনা করলে তাদের মাথাপিচু অবাদান কৃষি এবং সেবা খাতের তুলনায় বেশি। কৃষিতে নিয়োজিত দেশের ৪১ শতাংশ শ্রমশক্তির মোট জিডিপিতে অবদান ১৪ দশমিক ২৩ শতাংশ। সেবাখাতে নিয়োজিত দেশের ৩৯ শতাংশ শ্রমশক্তির মোট জিডিপিতে অবদান ৫২ দশমিক ১১ শতাংশ আর শিল্পখাতে নিয়োজিত দেশের মাত্র ২০ শতাংশ শ্রমশক্তির মোট জিডিপিতে অবদান ৩৩ দশমিক ৬৪ শতাংশ। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে ২০১৮ সালের হিসেব অনুযায়ী মোট জিডিপিতে গার্মেন্টস সেক্টর থেকে আয়ের অবদান ১১ দশমিক ১৭ শতাংশ (এই খাতের আমদানি ব্যায় বাদ না দিয়ে শুধু রপ্তানি আয়ের হিসাবে)। বৈদেশিক মুদ্রা বা দেশের উন্নয়নের কথা আসলে গার্মেন্টস সেক্টরের সাথে যে খাতটির কথা আসে সেটি হল রেমিটেন্স। তুলনা হিসেবে নয় তবে প্রাসঙ্গিক তথ্য হিসেবে বলা যেতে পারে, যে বছরের দেশের মোট জিডিপিতে গার্মেন্টস সেক্টর থেকে আয়ের অবদান ছিল ১১ দশমিক ১৭ শতাংশ (এই খাতের আমদানি ব্যয় বাদ না দিয়ে শুধু রপ্তানি আয়ের হিসাবে) সেই বছরে রেমিটেন্সের অবদান ছিল ৫ দশমিক ৪৭ শতাংশ।

গত তিন দশকে বাংলাদেশের উন্নয়ন নিয়ে কথা বলতে আসলে অনেকগুলো বিষয় আসতে পারে, তবে নিশ্চিত ভাবে জিডিপি গ্রোথ সবচেয়ে বেশি হাইলাইট হয়ে থাকে, সেই সাথে মাথাপিচু আয়। এই জিডিপি গ্রোথে যদি গার্মেন্টস সেক্টরের অবদান বিবেচনা করা যায়? ২০১৮ সালে জিডিপিতে গার্মেন্টস সেক্টরের অবদান ছিল ১১ দশমিক ১৭ শতাংশ, এর আগের দশকগুলোতে অবস্থা কি ছিল? ১৯৯১ সালে জিডিপিতে গার্মেন্টস সেক্টরের অবদান ছিল ২ দশমিক ৮০ শতাংশ আর ২০০০ সালে ছিল ৮ দশমিক ১৫ শতাংশ (এই খাতের আমদানি ব্যায় বাদ না দিয়ে শুধু রপ্তানি আয়ের হিসাবে)। একই সময় যদি মাথাপিচু আয়ের হিসেব দেখা যায়? ১৯৯১ সালে মাথাপিচু জিডিপি ছিল ২৯৩ মার্কিন ডলার, ২০০০ সালে ছিল ৪১৮ মার্কিন ডলার যেটা ২০১৮ সালে হয়েছে ১৬৯৮ মার্কিন ডলার । একই সময়ের মধ্যে লেবার প্রোডাক্টিভিটি প্রায় দ্বিগুন হয়ে গেছে ১২৫৫ থেকে ২৫৫০ মার্কিন ডলার।

এই উন্নয়েনের পিছনে শিল্প, কৃষি, সেবা সব খাতের অবদানই রয়েছে কিন্তু শিল্প খাত কিছুটা বেশি গুরুত্ব দাবী করতেই পারে। কেননা এই সময়ে (১৯৯০-২০১৮) দেশের জিডিপিতে সেবা খাতের অবদান প্রায় একই থেকে গেছে ৪৯ দশমিক ৭৩শতাংশ থেকে ৫২ দশমিক ১১ শতাংশ কৃষি খাতের অবদান অনেক কমে গেছে ২৯ দশমিক ২৩ শতাংশ থেকে ১৪ দশমিক ২৩ শতাংশ কিন্তু শিল্পখাতের অবদান বেড়েছে উল্লেখযোগ্য হারে ২১ দশমিক ০৪ শতাংশ থেকে ৩৩ দশমিক ৬৪ । আর দেশের শিল্প খাতে যে গার্মেন্টস সেক্টর কতখানি গুরুত্বপুর্ন সেটা আগের প্যারাতেই এসেছে।

বাংলাদেশের গার্মেন্টস সেক্টর নিয়ে যদি একটা সারাংশ করা যায় তাহলে সবচেয়ে প্রচলিত যে তথ্যগুলো আসবে তা হল; গার্মেন্টস সেক্টর মোট রপ্তানি আয়ের ৮৪ শতাংশ যেখানে বাংলাদেশের প্রতিযোগী বা সামান্য এগিয়ে/পিছিয়ে থাকা কিছু রাষ্ট্রের মোট রপ্তানি আয়ে তাদের প্রধান তিনটি রপ্তানি পণ্যের মিলিত অবদানও বাংলাশের প্রধানতম পন্যটির মোট রপ্তানি আয়ের ধার কাছেও নেই। এটি দেশের মোট জিডিপির ১১ দশমিক ১৭ শতাংশ । মোট শিল্পখাতে নিয়োজিত শ্রমশক্তির ৩৩ শতাংশ এই খাতে নিয়োজিত, শিল্পখাতে নিয়োজিত মোট নারী শ্রমশক্তির ৭০ শতাংশ এই খাতে কাজ করে। ১৯৯০ থেকে ২০১৮ এর মধ্যে দেশের মাথাপিচু জিডিপি বেড়েছে প্রায় ছয় গুণ একই সময়ে জিডিপিতে গার্মেন্টস সেক্টরের অবদান বেড়েছে প্রায় ৫ গুন (এই খাতের আমদানি ব্যায় বাদ না দিয়ে শুধু রপ্তানি আয়ের হিসাবে)।

শুধু এই পরিসংখানগত তথ্য বিবেচনা করলে মনে হয়ে বাংলাদেশের জন্য গার্মেন্টস সেক্টর আসলেই অনেক গুরুত্বপূর্ণ, যদিও এর বাইরেও অনেক পরিসংখ্যান আছে, যা বিবেচনায় নেয়া প্রয়োজন, যেমন এই রফতানি আয়ের কত টাকা এই খাতের কাঁচামাল বা মেশিনারি আমদানি করতে ব্যয় হচ্ছে, সরকার এই খাতে কত সহায়তা দিচ্ছে, কর্মীদের জীবনমানের উন্নয়ন কেমন হচ্ছে। এছাড়াও একটি সেক্টর দেশের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ সেটা পরিমাপের জন্য অন্যান্য সেক্টরে ওই সেক্টরের স্পিলওভার ইফেক্টও একটা বিষয়। গার্মেন্টস সেক্টর সেটা কতখানি রাখতে পেরেছে সেটাও বিবেচনা প্রয়োজন।

বাংলাদেশের গার্মেন্টস সেক্টর গ্লোবাল ভ্যালু চেইনের যে অংশ অবস্থিত তাতে বাংলাদেশ মূলত এই খাতের ম্যানুফ্যকচারিং এর সাথে জড়িত, এই পণ্যগুলোর ডিজাইন এবং মার্কেটিং এর কাজটি সাধারণত পশ্চিমা ক্রেতা প্রতিষ্ঠান বা তাদের প্রতিনিধি কোন প্রতিষ্ঠান করে থাকে। যদিও গত দেড় দশকে বাংলাদেশের গার্মেন্টস সেক্টর শুধু তাদের পণ্য বিক্রির পরিমান বৃদ্ধি করে নি বরং তাদের পণ্যের বৈচিত্রতা থেকে শুরু করে প্রোডাকশান আপগ্রেডিং এর মাধ্যমে তাদের প্রতিষ্ঠানগুলোকে আধুনিক করেছে। এই ধারাবাহিকতায় উৎপাদনের সাথে জড়িত অনেক কাঁচামাল দেশে উৎপাদনের সক্ষমতা তৈরি হয়েছে। তারপরেও এই খাতের কাঁচামাল বা মেশিনারি আমদানি করতে বেশ বড় অংকের অর্থ ব্যয় হচ্ছে। যদি রফতানি আয়ের কত অংশ এই খাতের কাঁচামাল আমদানিতে ব্যায় হচ্ছে সেই হিসাব করা হয় তাহলে দেখা যাবে এই খাত থেকে দেশে আসা বৈদেশিক মুদ্রার একটা উল্লেখযোগ্য অংশ চলে যাচ্ছে। সেটির পরিমান কত? বাংলাদেশে ব্যাংকের তথ্য মতে ২০১৮ সালের গার্মেন্টস সেক্টরের মোট রপ্তানি আয়ের ৩৯ দশমিক ০৬ শতাংশ ব্যায় হয়েছে এই খাতের কাঁচামাল এবং মেশিনারি আমদানিতে। টাকার অংকে যেটি ১১ দশমিক ৯৫ বিলিয়ন! ওই বছরে রপ্তানি ছিল ৩০ দশমিক ৬১ বিলিয়ন। অর্থাৎ আমাদানি ব্যায় বাদ দিলে এই খাত থেকে দেশের নিট বৈদেশিক মুদ্রার আয় ছিল ১৮ দশমিক ৬৬ বিলিয়ন। ওই বছরেই রেমিটেন্স খাতে আয় ছিল ১৪ দশমিক ৯৮ বিলিয়ন। এই হিসেবে জিডিপিতে ওই বছরের গার্মেন্টস সেক্টরের অবদান আসে ৬ দশমিক ৮১ শতাংশ যেটি এই আমদানি ব্যায় বাদ না দিয়ে হিসাব করা হলে হয় ১১ দশমিক ১৭ শতাংশ। এটি শুধু একবছরের চিত্র নয় বরং কোন বছরেই গার্মেন্টস খাতের আমদানি ব্যায় মোট রপ্তানি আয়ের ৩৫ শতাংশ এর নিচে নয়। অর্থাৎ রেডিমেড গার্মেন্টস সেক্টরের যে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার আয়ের কথা বলা হয়ে থাকে সেখানে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ব্যায়ের হিসাবটাও করা প্রয়োজন। তুলনা হিসেবে নয় তবে প্রাসঙ্গিক তথ্য হিসেবে বলা যেতে পারে ২০১৩ সালেও গার্মেন্টস খাতের আমদানি ব্যায় বাবদ যে পরিমান বৈদিশিক মুদ্রা ব্যায় হয়েছে তা বাদ দিলে গার্মেন্টস সেক্টর থেকে প্রাপ্ত বৈদেশিক মুদ্রা রেমিটেন্সের থেকে কম ছিল।

বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের বিষয়টি ছাড়া গার্মেন্টস সেক্টরের সবচেয়ে ইতিবাচক দিক ছিল শিল্প ক্ষেত্রে কর্মসংস্থান তৈরি, বিশেষ করে নারীদের কর্মসংস্থান তৈরি। গার্মেন্টস সেক্টরে নারী কর্মীদের স্বল্প মজুরি বিবেচনায় নিয়েও বলা যায় এই কর্মসংস্থান তাদের দারিদ্র্য হ্রাসে এবং ক্ষমতায়নে ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছে যা বিভিন্ন গবেষনায় এসেছে। কিন্তু নারী কর্মীদের দারিদ্র্য হ্রাসে এবং ক্ষমতায়নে গার্মেন্টস সেক্টর নিয়ে গবেষণায় একটি বিষয় প্রায় অনুপস্থিত থেকে গেছে। এই খাতে কর্মরত নারী কর্মীদের বয়স ২০ থেকে ৪০ এর মধ্যে । ৪০ এর অধিক বয়সের নারী কর্মী নেই বললেই চলে। এই নারী কর্মীরা সহনীয় মাত্রার দারিদ্র্য সীমা অতিক্রম করার জন্য যে মজুরি প্রয়োজন তাঁর চেয়ে সামান্য কিছু বেশি মজুরিতে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুরের মত বাংলাদেশের সবচেয়ে ব্য্যবহুল জায়াগাগুলোতে দৈনিক ১০ থেকে ১২ ঘন্টা করে ১৫ থেকে ২০ বছর কাজ করে। এরপর যখন তাঁদের জীবিকার এই খাতটি ছাড়তে হয় তারপর তাঁদের জীবনধারনের কি উপায় হয়? এই খাত তাঁদের জীবনের পরবর্তী ৩০-৩২ বছর (গড় আয়ু হিসেবে) এ কি ইতিবাচক কোন পরিবর্তন আনবে কি না সে বিষয়ে কোন গবেষণা নেই বললেই চলে। এই বিষয়ে তথ্য ছাড়া এই খাত তাঁদের কর্মীদের জীবনমানের উন্নয়ন করছে বা দারিদ্য হ্রাস করছে তা নিশ্চিত ভাবে বলা কঠিন।

একটি সেক্টর দেশের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ সেটা পরিমাপের জন্য অন্যান্য সেক্টরে ওই সেক্টরের স্পিলওভার ইফেক্ট গুরুত্বপূর্ণ। গার্মেন্টস সেক্টরের অগ্রগতি বাংলাদেশের অন্যান্য সেক্টরের জন্য যথেস্ট ইতিবাচক ভূমিকা পালন করেছে, বিশেষ করে স্পিনিং, ডাইয়িং শিল্প সহ গার্মেন্টস সেক্টরের বিভিন্ন কাঁচামাল ও খুচড়া যন্ত্রাংশের শিল্প পুরোপুরি গার্মেন্টস সেক্টরের প্রবৃদ্ধির সাথে বিকাশ লাভ করেছে। গার্মেন্ট সেক্টরের সাথে গড়ে উঠা সংযুক্ত শিল্পগুলো বাংলাদেশের ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের জন্য অত্যান্ত ইতিবাচক ছিল।

এছাড়াও বাংলাদেশের আর্থিক খাতে ব্যাংক ও বীমার মত খাত ও সেবা খাতের পরিবহন, হোটেল, ইত্যাদিও গার্মেন্টস সেক্টরের প্রবৃদ্ধির সাথে উল্লেখযোগ্য হারে প্রসার লাভ করছে। বলা হয়ে থাকে অনুন্নত বা উন্নয়নশীল দেশের শ্রমনিবিড় শিল্পগুলো দেশের অন্যান্য শিল্পের উপর সেরকম কোন উল্লেখযোগ্য ইতিবাচক পরিবর্তন রাখে না কেননা এতে প্রযুক্তি বা পুজি স্থানান্তরের সুযোগ কম। সে বিবেচনায় বাংলাদেশের গার্মেন্টস সেক্টরের অন্যন্য খাতে অবদান নেহাত কম নয়।

বাংলাদেশের গার্মেন্টস সেক্টর নিয়ে নানা ইতিবাচক নেতিবাচক কথা আছে। সাম্প্রতি সেটির মাত্রা দুই তরফেই বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু নানা সীমাবদ্ধ সত্তেও এই খাতটি দেশের প্রধান রপ্তানি খাত। গত ৬ বছর ধরে সবচেয়ে বেশি নিট বৈদেশিক মুদ্রা এই খাত থেকেই এসেছে। শিল্প খাতে সর্বোচ্চ কর্মসংস্থান এই খাতের মাধ্যমেই তৈরি হয়েছে এমন কি দেশের সেবা খাতের কর্মসংস্থান বৃদ্ধিতেও এই খাতের অবদান অনেক। তারপরেও বাংলাদেশের জন্য গার্মেন্টস সেক্টর কত গুরুত্বপূর্ণ সেটার উত্তর শুধু কিছু পরিসংখ্যান বা অন্য কোন খাতের সাথে তুলনার মাধ্যমে দেয়া যৌক্তিক হবে না। এই খাতের সীমাবদ্ধতা গুলোর সমাধান চাইলে এর সমালোচনার চেয়ে জরুরি এর বিকল্প তৈরি করা। কেননা বাংলাদেশের জন্য গার্মেন্টস সেক্টর কত গুরুত্বপূর্ণ এই প্রশ্নের একটি উত্তর হল বাংলাদেশের জন্য গার্মেন্টস সেক্টরের বিকল্প এখনো নেই।

করোনা এবং ঘুরে দাড়ানোর গল্পঃ

২০২০ সালে করোনা সংক্রমণের প্রভাবে বাংলাদেশের রফতানি আয় ক্রমেই কমতে শুরু করে। এই আয় কমার ক্ষেত্রে মূল প্রভাব যে তৈরী পোশাক খাতের ওপর, তাতে সংশয় নেই। নানা সম্ভাবনা ও সীমাবদ্ধতার মধ্য দিয়ে তৈরী পোশাক খাত বিশ্ববাজারে নিজের স্থান করে নিচ্ছিল। কিন্তু বিশ্বব্যাপী কোভিড-১৯ এর ভয়াবহ হানায় বড় ধরনের চ্যালেঞ্জে পড়ে বাংলাদেশের এই খাত। তৈরী পোশাক খাতের এই বিপন্নতার মুখে সরকার দারুন ভূমিকা পালন করে।

২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম মাসে তৈরী পোশাক খাতের রফতানি আয় ১১ শতাংশের বেশি কমে যায়। দুই বছর আগের একই সময়ের সাথে তুলনা করলে ‘নেতিবাচক রফতানি প্রবৃদ্ধি’ আরো বেশি হবে। রফতানির তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০২১-২২ অর্থবছরে প্রথম মাসে ২৮৮ কোটি ৭২ লাখ ডলারের তৈরী পোশাক পণ্য রফতানি করেছে বাংলাদেশ যা মোট রফতানি আয়ের ৮১ দশমিক ১৬ শতাংশ।

১২ দিনের বেশি কারখানা গুলো বন্ধ থাকায় আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে পোশাক রফতানি কমে যায় ১১ দশমিক ২ শতাংশ। লক্ষ্যের চেয়ে আয় কমে ৪ দশমিক ১৭ শতাংশ। একই সময়ে নিট পোশাক রফতানি প্রবৃদ্ধি কমে ৫ দশমিক ২৫ শতাংশ। লক্ষ্যমাত্রা কমে শূন্য দশমিক ৮৬ শতাংশ। ওভেন পোশাক রফতানি খাতে এই সময়ে ১৭ দশমিক ৭৯ শতাংশ প্রবৃদ্ধি কমেছ। ৮ দশমিক ২৯ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রা কমে যায়।

আমাদের দেশের কারখানাগুলো যে নিয়মে উৎপাদন ব্যবস্থাপনা ও রপ্তানী বাণিজ্যে নিজেদের শক্ত অবস্থান অর্জনে নিজেদের সক্ষমতার প্রমান দেখাচ্ছিল তার ভিতরে কতখানি অদক্ষতা ও পৌরাণিক পদ্ধতি ছিল তা মূলত উন্মোচিত হয়ে পড়ে এই করোনার ধাক্কায়। সারা বিশ্বের সকল ব্যবসা বাণিজ্য ব্যবস্থাপনায় ও এর প্রমান মেলে। বিশ্বের বড় ব্র্যান্ড, রিটেইলার গণের দেউলিয়াত্ব প্রকাশ পায়।

অন্যদিকে নতুন চ্যালেঞ্জ হিসেবে পোশাক রফতানিতে বাংলাদেশকে পেছনে ফেলে দ্বিতীয় স্থানে উঠে আসে ভিয়েতনাম। কয়েক বছর ধরেই বাংলাদেশের কাছাকাছি অবস্থান করছিল এশীয় দেশটির রফতানি আয়। শেষ পর্যন্ত কিছু সময়ের জন্য দ্বিতীয় শীর্ষ অবস্থানেই উঠে আসে ভিয়েতনাম। বাংলাদেশ পোশাক রফতানিতে তৃতীয় স্থানে অবস্থানে চলে আসে। চায়নার পোশাক রপ্তানী বাণিজ্যের সাথে বাংলাদেশ এবং ভিয়েতনামের রপ্তানীর পার্থক্য অনেক বেশি।

ডব্লিউটিওর প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২০ সালে চীন সবচেয়ে বেশি ১৪ হাজার ২০০ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি করেছে।

ডব্লিউটিওর প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২০ সালে চীন সবচেয়ে বেশি ১৪ হাজার ২০০ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি করেছে। যদিও আগের বছরের চেয়ে দেশটির পোশাক রপ্তানি ৭ শতাংশ কমেছে। এখনও চীন বিশ্বের মোট পোশাক রপ্তানি ৩১ দশমিক ৬ শতাংশ দখলে রেখেছে।

একক দেশ হিসেবে ভিয়েতনাম দ্বিতীয় পোশাক রপ্তানিকারক হলেও ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত (ইইউ) দেশগুলো সম্মিলিতভাবে এই জায়গা বহুদিন ধরেই দখল করে আছে। গত বছর ইইউর দেশগুলো নিজেদের অঞ্চলে ১২ হাজার ৫০০ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি করেছে। আর ইইউর বাইরে তাদের রপ্তানির পরিমাণ ৩ হাজার ৮০০ কোটি ডলার।

এদিকে বাংলাদেশ যেমন ভিয়েতনামের কাছে জায়গা হারিয়েছে, তেমনি ভারতকে টপকে চতুর্থ শীর্ষ পোশাক রপ্তানিকারক হয়েছে তুরস্ক। গত বছর ভারত ১ হাজার ৩০০ কোটি ডলার রপ্তানি করলেও তুরস্ক করেছে ১ হাজার ৫০০ কোটি ডলারের। যদিও ২০১৯ সালে ভারতের রপ্তানি ছিল ১ হাজার ৭০০ কোটি ডলার। আর তুরস্কের ছিল ১ হাজার ৬০০ কোটি ডলার।

ডব্লিউটিওর হিসাব অনুযায়ী, ২০২০ সালে চীন, ভিয়েতনাম, বাংলাদেশসহ শীর্ষ ১০ রপ্তানিকারক দেশ ৩৭ হাজার ৮০০ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি করেছে। সামগ্রিকভাবে তাদের রপ্তানি কমেছে ১২ শতাংশ। ২০১৯ সালে শীর্ষ ১০ রপ্তানিকারক দেশের পোশাক রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৪১ হাজার ১০০ কোটি ডলারের।

২০২০ সালে সবচেয়ে বেশি ১৮ হাজার কোটি ডলারের পোশাক আমদানি করেছে ইইউভুক্ত দেশগুলো। দ্বিতীয় শীর্ষ যুক্তরাষ্ট্র আমদানি করেছে ৯ হাজার ৫০০ কোটি ডলারের পোশাক। তা ছাড়া জাপান ৩ হাজার ও যুক্তরাজ্য ২ হাজার ৬০০ কোটি ডলারের পোশাক আমদানি করেছে।

বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) প্রতিবেদনের তথ্যমতে, ২০২০ সালে ভিয়েতনাম দুই হাজার ৯০০ কোটি ডলারের পোশাক রফতানি করেছে। আর বাংলাদেশ রফতানি করেছে দুই হাজার ৮০০ কোটি ডলারের পোশাক। অথচ তার আগের বছর বাংলাদেশের রফতানি ছিল তিন হাজার ৪০০ কোটি ডলার। তখন ভিয়েতনামের রফতানি ছিল তিন হাজার ১০০ কোটি ডলার।

আমরা সকলেই জানি যে, তৈরী পোশাক শিল্প অন্য যে কোনো খাতের তুলনায় বেশি সংবেদনশীল। এই খাতের ইনপুট তথা কাঁচামালের জোগান যেমন নিরবচ্ছিন্ন থাকতে হয় তেমনিভাবে বাজারে উৎপাদিত রফতানি পণ্য পৌঁছানোও সঙ্কটমুক্ত থাকতে হয়। এর বাইরে উৎপাদনখরচ এবং পণ্যের রফতানি মূল্যের মধ্যকার মূল্য সংযোজন যৌক্তিক একটি পর্যায়ে থাকতে হয়। কোভিড-১৯ এর প্রভাব পড়ে এই সকল ব্যবস্থাপনা ভেঙে পড়ে । সারা বিশ্বের পোশাক শিল্প এক ধরনের অভূতপূর্ব মানবিক ও ব্যবসায়িক বিপর্যয়ের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যায় । করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ায় , পরিস্থিতি মোকাবেলা করার জন্য, সরকার বিভিন্ন সময় দেশব্যাপী ছুটি ঘোষণা করে এবং জরুরি পরিষেবা ছাড়া ব্যবসা ও শিল্পকার্যক্রম বন্ধ রাখতে হয়। অনেক আন্তর্জাতিক ক্রেতা নিশ্চিত করা ক্রয় আদেশ বাতিল বা স্থগিত করে রাখে ।

বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) তথ্য মতে, আন্তর্জাতিক ক্রেতারা ১৮ এপ্রিল ২০২০ পর্যন্ত ১১৪২টি কারখানার ৩.১৬ বিলিয়ন ডলারের পোশাক চালান বাতিল বা স্থগিত করেছে যার প্রভাব পড়েছে সাড়ে ২২ লাখ শ্রমিকের ওপর। বিশ্বব্যাপী পোশাকের চাহিদাও কোভিড মন্দার কারণে কমে যাচ্ছে। বিজিএমইএ এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইতোমধ্যে ১০ লাখ শ্রমিক কর্মহীন হয়েছে। সরকারি লকডাউন অমান্য করে, হাজার হাজার আরএমজি কর্মীকে বকেয়া মজুরির দাবিতে সারা দেশে রাস্তায় বিক্ষোভ করতেও দেখা গেছে।

► জাতিগত জটিলতাঃ Bangladesh Garments Industry

🔹 যে কোন জাতির ইন্ডাস্ট্রির রেভ্যুলেশনে ওই দেশের সরকারের অংশগ্রহন ভীষণ ভাবে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। বিপদের দিনে সরকারের এগিয়ে আসা, প্রনোদনা প্রদান, সফট লোন প্রদান এর চেয়ে সরকার উদ্যোগী হয়ে কোন একটা বিশেষ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ওই ইন্ডাস্ট্রির বিকাশে কাজ করে যাওয়া, এই দুইটা ব্যাপার পুরোপুরি ভাবে আলাদা। এবং যে কোন জাতির ইন্ডাস্ট্রিয়াল উত্থানে এর গুরুত্ব অপরিসীম। উদহারণ হিসেবে বর্তমান সরকারের নিজস্ব উদ্যোগে ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মানে যতগুলো কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে সেটাকে বিবেচনায় নিলেই ব্যাপারটা পরিষ্কার হবে।

যেহেতু আমাদের পোশাক শিল্পের বিকাশের ইতিহাস ব্যক্তি মালিকানাধীন ছোট ছোট কারখানা স্থাপনের মাধ্যমে। তাই সেখানে সরকারের অংশগ্রহন ছিল নগন্য আকারে, সরকারী ব্যাংক গুলোর ব্যাংকিং সেবা প্রদানের মাধ্যমে। এক্সপোর্ট করার ব্যাপারে জটিলতার অন্ত ছিলোনা। ইমপোর্ট করা তো রীতিমত দুঃসাধ্য ছিল। নুরুল কাদের সাহেব অবসরপ্রাপ্ত সচিব ছিলেন, সরকারের ঘনিষ্টতা অর্জনে সক্ষম ছিলেন, তাই তার পুরাতন বন্ধুবান্ধব গণের সাথে কথা বলে, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর সাহেব কে ভবিষ্যৎ সুযোগ সুবিধার কথা গুলো বুঝিয়ে শুনিয়ে, ব্যাক-টু-ব্যাক ফ্যাসিলিটি , বন্ডেড ওয়ারহাউজ সুবিধা গুলো আদায় করিয়ে নিতে পেরেছিলেন। এবং এখন সেই সুফল আমরা ৪০ বছর পরে ও ভোগ করছি। মূলত তৎকালীন সরকার সমূহ তখনো পাট মন্ত্রণালয় নিয়েই কাজ কর্ম করতেন।

► আন্তর্জাতিক বাজার সংক্রান্ত জটিলতাঃ

► নীতিমালা সংক্রান্ত জটিলতাঃ

আশির দশকের শুরু থেকে বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের উত্থান এবং প্রতিনিয়ত বিকশিত হওয়ার গল্পের ভিতর দিয়ে যখন পরিক্রমা করবেন, আপনাকে প্রত্যেকটা বছর এর খবর গুলো নিয়ে একটু পর্যালোচনা করে দেখতে হবে। একটু খেয়াল করলেই দেখবেন কারখানা গুলো বড় হচ্ছিল, জনবল বেড়ে যাচ্ছিল, নতুন নতুন উদ্যোক্তা তৈরী হচ্ছিল, ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ কারখানা নিয়ে একটা সময় পত্র পত্রিকায় খুব লেখালেখি হচ্ছিল। প্রতিদিন শুধু সাফল্যের খবর প্রচারিত হচ্ছিল। নানা প্রকার পুরস্কার প্রদানের ও রেওয়াজ চালু হচ্ছিল এবং সকল কিছুই সম্প্রসারিত হচ্ছিল বড্ড বেশি সেকেলে নিয়মে।

প্রযুক্তির কোন ছোঁয়ার প্রয়োজন কেউই অনুভব করছিলনা। মানব সম্পদ উন্নয়ন নিয়ে কোন বাস্তবিক পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছিলনা। অগাধ সম্পদের মালিক হওয়ার পরে ও নিত্য নতুন টেকনোলজিতে ইনভেস্টমেন্ট করার কোন মানসিকতা দেখা যেতনা। উৎপাদনের উৎকর্ষতা সাধনে শুধুই স্বস্তা শ্রমিক বাড়িয়ে দিয়ে কিভাবে শুধুই সংখ্যা বাড়ানো যায়, তা নিয়ে রীতিমত প্রতিযোগিতা চলত। অফিস ম্যানেজমেন্টে নতুনত্বের ছোয়ার কোন বালাই ছিলোনা, হিউম্যান রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট টিম কে শেষের দিকের কোন একটা ডিপার্টমেন্ট হিসেবে পরিগণিত করা হত। এক কথায় বলা যেতে পারে যে একটা অসুস্থ্য বিকাশ ঘটছিল।

কারখানা গুলো অনাকাঙ্খিত ভাবে বড় হয়ে যাওয়ার কারণে শ্রমিক অসন্তোষ গুলো মাঝে মাঝেই মাথা চাড়া দিয়ে উঠছিল। বড় অর্ডার গুলো ঠিক মত ব্যবস্থাপনা করে সঠিক সময়ে শিপমেন্ট দেয়া যাচ্ছিলনা। ঢাকা এয়ারপোর্ট, চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দর দিনে দিনে এক আতংকে রূপান্তরিত হচ্ছিল। ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ শিল্পের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে লেখালেখির পরে দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে ওঠে ভার্টিক্যাল নীট গ্রূপের কনসেপ্ট। ব্যাংক গুলো এই ভার্টিক্যাল সেটআপ এর সিংহভাগ অর্থ বরাদ্ধে প্রতিযোগিতায় নেমে পড়লো। বুঝে না বুঝে অনেকেই কারখানা সম্প্রসারণে এগিয়ে এল। আগের ছোট্ট ইউনিট নিয়ন্ত্রণ করতে না পারার ম্যানেজমেন্ট এবং টিমের উপর চাপিয়ে দেয়া হল আরো তিনটা নতুন ইউনিটের বোঝা। বিপদ সৃষ্টি হল নিজেরই নির্বুদ্ধিতার জন্যই কিন্তু যে কোন ভাবে টাকা পয়সার বুৎপত্তি লাভ হল, তাই ইন্ডাস্ট্রি এগিয়ে যাচ্ছে বলে ধারণা করা হল।

এত বড় ভার্টিক্যাল ইন্ডাস্ট্রি পরিচালনা করতে জনবল খোজ করা শুরু হল, এবং চরম পর্যায়ের বোকামী করে আমরা সেই সকল বিদেশী উর্দ্ধতন কর্মকর্তা নিয়োগ করলাম যাদের ছিল দুরস্ত ইংরেজী বলার ক্ষমতা, চোটপাট করার পারঙ্গমতা এবং যে কোন বিষয়ে জ্ঞান দান করার অভূতপূর্ব বিচক্ষণতা। ভার্টিক্যাল ইন্ডাস্ট্রি নিয়ে কোন অভিজ্ঞতা ছাড়াই, জীবনে এত বড় সেটআপে কাজ না করে ও তারা ভুলভাল ভাবে ইন্ডাস্ট্রিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে থাকলো। আমরা ও নতুন নতুন ডলার দেখে বিমোহিত হয়ে পড়লাম। মূলত নীরবে কত বড় ক্ষতি হয়ে যাচ্ছিল সেই বিষয়ে কোন প্রকার বাস্তবচিত পদক্ষেপ ও গ্রহণ করলাম না। আমার মনে হয় আমাদের সক্ষমতা তৈরির পূর্বেই মাথা ভারী তিন চার প্রকার শিল্পের একীভূত করণ কিংবা ভার্টিক্যাল ইউনিট সেট-আপ একটা অন্যতম ভুল সিদ্ধান্ত ছিল। আমাদের প্রতিযোগী কোন দেশেই এই ভাবে ভার্টিক্যাল ইউনিট প্রতিষ্ঠা লাভ করেনি। আমরাই বোকামীর রোল মডেল হিসেবে আছি। যেহেতু বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ রপ্তানীকারকের ভূমিকায় আসীন হয়ে ছিলাম তাই সুখের অন্ত ছিলনা।

আমরা শুধু সমস্যা সৃষ্টি হলেই নড়েচড়ে বসি। মূলত সুষ্ঠ কোন নীতিমালা কখনই মেনে চলতে চেষ্টা করিনি। নীতিমালা তেমন ছিল ও না। থাকলেও হয়ত মানতাম না।

► উদ্যোক্তা সম্পর্কিত জটিলতাঃ

► শ্রমিক সংক্রান্ত জটিলতাঃ

► কর্মচারী সংক্রান্ত জটিলতাঃ

► কর্মকর্তা সংক্রান্ত জটিলতাঃ

► ব্যাংকিং, অর্থায়ন এবং নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত জটিলতাঃ

► ইন্ডাস্ট্রির নেতৃত্ব সংক্রান্ত জটিলতাঃ

► পোশাক শিল্পের ধরণ, পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত জটিলতাঃ

► পোশাক শিল্পের বিগত ২০০ বছরের ইতিহাস পর্যালোচনা .

Digital Marketing Strategist & SEO Expert in Bangladesh. Md Mustakur Rahman has been working for the garment Buyerslist since 2013. He lives in Dhaka, Bangladesh, where he works as an editor at Avronbd. The owner of the company is Avron Texwear. He offers professional-designed and manufactured clothes and exporters in Bangladesh. He has been working in the clothing industry for the last 10 years, and he has lots of experience in this field. He is additionally a Professional Digital Marketing Strategist & SEO Expert in Bangladesh.

Share this content:

Leave a Comment

Sign In

Register

Reset Password

Please enter your username or email address, you will receive a link to create a new password via email.